Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মাদ্রাসায় যাব বলতেই প্রশ্নবাণ

মাদ্রাসাটার নাম জানতে চাওয়াতেই কুঁচকে গেল ভুরুগুলো? জবাব তো এলই না। উল্টে পাল্টা প্রশ্ন “কে আপনি, কেন যাবেন ওখানে, কী দরকার?” যাব ঘোড়ামারার মাদ্রাসায় (পোশাকি নাম ‘আল মাদ্রাসাতু দারুত্ তাওহীদ’)। কিন্তু যাওয়ার কারণটা প্রশ্নকর্তাদের কাছে খোলসা করে বলা সম্ভব ছিল না। বলা গেল না বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডের তদন্তে নেমে গোয়েন্দাদের নজরে এসেছে এই মাদ্রাসা।

ঘোড়ামারার সেই মাদ্রাসা। ছবি: বিশ্বজিৎ রাউত।

ঘোড়ামারার সেই মাদ্রাসা। ছবি: বিশ্বজিৎ রাউত।

সুজাউদ্দিন
ডোমকল শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৪ ০৪:০০
Share: Save:

মাদ্রাসাটার নাম জানতে চাওয়াতেই কুঁচকে গেল ভুরুগুলো? জবাব তো এলই না। উল্টে পাল্টা প্রশ্ন “কে আপনি, কেন যাবেন ওখানে, কী দরকার?”

যাব ঘোড়ামারার মাদ্রাসায় (পোশাকি নাম ‘আল মাদ্রাসাতু দারুত্ তাওহীদ’)। কিন্তু যাওয়ার কারণটা প্রশ্নকর্তাদের কাছে খোলসা করে বলা সম্ভব ছিল না। বলা গেল না বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ-কাণ্ডের তদন্তে নেমে গোয়েন্দাদের নজরে এসেছে এই মাদ্রাসা। বর্ধমান জেলারই মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া এবং মুর্শিদাবাদের লালগোলার মকিমনগরের পাশাপাশি, ঘোড়ামারার মাদ্রাসা নিয়েও তৈরি হয়েছে সন্দেহের মেঘ। অন্য দু’টির মতো এই মাদ্রাসার নামও উঠে এসেছে বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ধৃত রাজিয়া বিবি এবং আলিমা বিবিদের জেরা করে।

কোঁচকানো ভুরুর মালিকদের এ তথ্যও দেওয়া গেল না যে খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণস্থলেই এক টুকরো পোড়া কাগজে মিলেছিল ২০১২ সালে গড়ে ওঠা অননুমোদিত এই মাদ্রাসার নাম। তাঁদের জানানো গেল না যে বিস্ফোরণে হত শাকিল আহমেদের সঙ্গেও এই মাদ্রাসার নাম জড়িয়েছিল বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। রাজিয়া-আলিমাদের জেরা করে তাঁরা জেনেছেন, এই মাদ্রাসার পাশেই জেহাদি ‘সংগঠনের’ নতুন বাড়ি তৈরির জন্য বেশ কিছুটা জমিও কেনা হয়।

মুর্শিদাবাদের ডোমকল ব্লক সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম এই ঘোড়ামারা। এলাকাবাসীর প্রায় সবাই কৃষিজীবী।

বুধবার বিকেলে গ্রামে ঢোকার মুখে মাদ্রাসাটার কথা জিজ্ঞাসা করতেই এগিয়ে এলেন কয়েক জন। ঠিকানা তো বললেনই না, উল্টে এক টানা প্রশ্ন। তার পরে জবাবের জন্য অপেক্ষা না করেই প্রশ্নকর্তারা দ্রুত সেঁধিয়ে গেলেন রাস্তার দু’পাশের ধান খেতে।

গ্রামের মূল রাস্তা থেকে মাদ্রাসায় দিকে যাওয়ার কোনও আলাদা বড় রাস্তা নেই। নেই কোনও নির্দেশিকা বা বোর্ড। কয়েকটি বাড়ির পাশ দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে কাঁঠালের বাগান। আচমকা মনে হবে, সরু রাস্তাটা বুঝি সেখানেই শেষ হয়ে গেল। সেই বাগান থেকে বেরিয়ে আল-পথে মাদ্রাসায় যাওয়া যায়। তবে সে পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই ফের দাঁড়াতে হল কয়েক জনের প্রশ্নের মুখে পড়ে। ‘কোথায়-কেন’র পাশাপাশি এ বারের সংযোজন: “ঘোড়ামারার মাদ্রাসা তো অনেক আগেই ফেলে এসেছেন। আপনাকে আবার পিছনে ফিরে যেতে হবে।”

শেষ পর্যন্ত কাঁঠালবাগানের মধ্যে এক জন চোখের ইশারায় বোঝালেন, ঠিক রাস্তায় চলেছি। গন্তব্য দূরে নয়।

মাদ্রাসায় ঢোকার মুখেই একটা কাঁঠাল গাছ। তার আগেই ফের ছেঁকে ধরল ভিড়। ফের একপ্রস্ত প্রশ্নবাণ।

আনুমানিক বারো কাঠা জমিতে মাদ্রাসা। পাকা ঘর দু’টো। দু’টো ঘরে ইটের গাঁথনি, ছাদ টিনের। পাঠকাঠির চাল ও বেড়া দেওয়া আরও গোটা চারেক ঘর রয়েছে। বারান্দার একটি অংশে অফিসঘর। দেওয়ালে ব্ল্যাকবোর্ডের উপরে সাঁটানো রয়েছে ছুটির নোটিস। তবে তা এমন ভাবে ছেঁড়া যে পড়ার উপায় নেই। ব্ল্যাক-বোর্ডে চকের দাগ স্পষ্ট। তোরিখের অংশটা মোছা। মাদ্রাসাটা বন্ধ কেন, ঈদের ছুটি না কি?

ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হাজি লোকমান মণ্ডলের ছেলে রুহুল আমিন মণ্ডল (যদিও তিনি নিজের পরিচয় দেননি, পরিচয় পরে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়)। বছর পঞ্চাশের রুহুল বললেন, “বর্ধমানে কী সব হয়েছে। সে জন্যই মাদ্রাসায় কেউ আসতে চাইছে না। তাই মাদ্রাসা বন্ধ।” রুহুলকে সঙ্গে দেখে ভিড়টা ছড়াতে শুরু করে। তবে চোখগুলো থেকে সন্দেহ মোছেনি। রুহুলই জানালেন, ৫০ জন ছাত্র (স্থানীয় ৩০ জন) নিয়ে চলা এই মাদ্রাসায় জনা তিনেক শিক্ষক। অনুরোধ করেও শিক্ষকদের ঠিকানা, ফোন-নম্বর পাওয়া গেল না। স্থানীয় ছাত্রদেরও হদিস মিলল না।

মাদ্রাসার সব ঘরের দরজা তালাবন্ধ। খোলা জানলা দিয়ে দেখা গেল, ছড়িয়ে রয়েছে লেপ-কাঁথা, গামলা, বালতি, হাঁড়ি-সহ রান্নার সরঞ্জাম। পাশের একটি ঘরে দড়িতে ঝুলছে লুঙ্গি, গামছা। টিনের ছাদে শুকোচ্ছে জামা। দেখলে মনে হচ্ছে এখানে যারা ছিল, তারা যেন কোনও খবর পেয়ে তড়িঘড়ি চলে গিয়েছে।

ঘরের লোক উধাও। অগোছালো হয়ে পড়ে রয়েছে জিনিসপত্র।
বৃহস্পতিবার ডোমকলের ঘোড়ামারায়।—নিজস্ব চিত্র।

মাদ্রাসার পিছনেই ইটের পাঁজা। স্থানীয় সূত্রের খবর, সে-ই ইট পড়েছে বড়জোর মাসখানেক। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ওই জমির পাশেই জমি নিয়েছিল শাকিলরা।

মাদ্রাসা সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানতে চাওয়ায় ‘‘জরুরি কাজ আছে’’ বলে চলে যান রুহুল। মাদ্রাসার সভাপতি তথা রুহুলেরই ভাই মরজেম আলি দাবি করেন, “একটা সময় মাদ্রাসাটার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এখন যোগাযোগ নেই। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।” বুধবার বিকেলে ঘোরামারা ছাড়ার আগে দেখেছিলাম মাদ্রাসার সামনের জমিতে ক্রিকেটের আসর জমিয়েছে কচিকাঁচারা।

বৃহস্পতিবার ঘোড়ামারায় ফিরে যেতেই, ঝটকা। কোনও প্রশ্ন-কর্তা নেই। কিন্তু ক্রিকেট-খেলার মাঠটা রাতারাতি হয়ে গিয়েছে চষা-জমি। মাদ্রাসার চালে যে জামাকাপড় মেলা ছিল, সেগুলো উধাও। স্রেফ ‘নেই’ ঘরের ভিতরের বেশ কিছু জিনিস। হলটা কী? আশপাশে ঘোরাঘুরি করা প্রৌঢ়া মুখঝামটা দেওয়ার মতো করে ধমক দিলেন, “অত কথায় কাজ কী? কী করবেন আপনারা ছবি নিয়ে?”

বড়জোর দু’কিলোমিটার দূরে মাদ্রাসারই এক শিক্ষকের বাড়ি। বাড়িতে আছেন তিনি? মহিলা-কণ্ঠের জবাব, “সে নেই। কোথায় আছে বলতে পারব না। ওর ফোন নম্বরও জানি না।” ফিরে আসতে হল। পথের দু’পাশে ধানখেতের ফাঁক, গাছের আবডাল থেকে অনেকগুলো কুঁচকে যাওয়া চোখ নজর রাখছিল। চোখগুলোতে সন্দেহের ছায়া সেই তখন থেকে, যখন থেকে বলেছি, “ঘোড়ামারার মাদ্রাসায় যাব।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE