সমস্যাটা প্রথম প্রকাশ্যে এসেছিল মাস ছয় আগে। আড়িয়াদহ ধ্রুবাশ্রমের আবাসিক ১২-১৭ বছরের ছেলেদের এক দিনের জন্য শিক্ষামূলক ভ্রমণে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সাধারণত হোমের ছেলেমেয়েরা বাইরে ঘুরতে যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গোনে। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ ছেলেই আগ্রহ দেখায়নি। বেরোনো থেকে অব্যাহতি চেয়েছিল।
ব্যাপারটা অন্য রকম ঠেকায় তাদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলে চমকে যান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা। জানা যায়, নিম্নাঙ্গে পরার অন্তর্বাস নেই তাদের। সরকারি হোমে কোনও বছর টেনেটুনে একটি অন্তর্বাস জোটে, কোনও বছর তা-ও মেলে না। কৈশোরে পা দেওয়া বা তারুণ্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া হোমের অধিকাংশ ছেলেরই তাই পরার মতো অন্তর্বাস নেই। চূড়ান্ত অস্বস্তি আর লজ্জায় তারা বাইরে যাওয়ার থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়। লোকের সামনে বেরোতে চায় না। খেলাধুলো করা, সাঁতার কাটার ক্ষেত্রেও অসুবিধেয় পড়ে তারা। হোম কর্তৃপক্ষকে বলেও লাভ হয়নি। তাদের অভিযোগ, ‘‘অন্তর্বাসের কথা বললেই শুনতে হয়, সরকার যা টাকা দিচ্ছে, তাতে দু’বেলা খাওয়া, টিফিন, পড়াশোনার জিনিস কেনা হচ্ছে। সেটাই অনেক। অন্তর্বাসটা বিলাসিতা! আমাদের সেই বিলাসিতা সাজে না।’’
এই অবস্থার কথা শুনে তখনই রাজ্যের সব সরকারি হোমে ছেলেদের নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস কেনার সুপারিশ করেছিলেন হোম নজরদারিতে গঠিত সরকারি কমিটির প্রধান অশোকেন্দু সেনগুপ্ত। তাতে কোনও স্তরেই কারও হেলদোল হয়নি। আড়িয়াদহ ধ্রবাশ্রম ও বারাসতের কিশলয়ের মতো রাজ্যের দুই নামী ছেলেদের হোমে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এখনও বছরে একটি মাত্র অন্তর্বাসই বরাদ্দ। কোনও ভাবে তা হারিয়ে গেলে, ছিঁড়ে গেলে বা ভিজে গেলে দ্বিতীয়টি মিলবে না। অশোকেন্দুবাবুর কথায়, ‘‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও অমানবিক ব্যাপার। এখনই সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আমাদের হাতে তো সুপারিশ করা ছাড়া আর ক্ষমতা নেই।’’ অভিযোগ, শুধু নাবালকদের হোম নয়, ভবঘুরেদের হোমগুলির অবস্থা আরও খারাপ। ভবঘুরে বিভাগের কমিশনার বিশ্বনাথ চক্রবর্তীই জানান, রাজ্যে পুরুষ ভবঘুরেদের ৯টি হোম রয়েছে। কোথাও নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাস মেলে না।
সমাজকল্যাণ দফতর সূত্রে খবর, সমস্যা আছে বহু মেয়েদের হোমেও। আবাসিকেরা প্রয়োজনমতো অন্তর্বাস পান না, পান না স্যানিটারি ন্যাপকিন। অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করতে হয়। যা থেকে যৌনাঙ্গে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। সল্টলেকের সুকন্যা হোমের সুপার শিউলি বালার দাবি, ‘‘মেয়েরা স্যানিটারি ন্যাপকিন পেত না। এক বছর আগে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দিল্লি থেকে প্রচুর ন্যাপকিন আনিয়ে দিয়েছিল। সেই স্টক এখনও রয়েছে। মাসখানেকের মধ্যেই আবার অর্ডার দেব।’’ যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওই ন্যাপকিন দিয়েছিল, তাদের তরফে ঝুমা পাইন বলেন, ‘‘মেয়েরা এখনও ন্যাপকিন পাচ্ছে না। ওরা আমাদের বলেছে। ৬০ জন মেয়ে এক বছর ব্যবহার করতে পারে, এমন সংখ্যক ন্যাপকিন আমরা আনিয়েছিলাম গত বছর এপ্রিলে। সুকন্যায় এখনই ৮২ জন আছে। এ দিকে ন্যাপকিনের ভাঁড়ার শূন্য।’’
বিষয়টি শুনে সমাজকল্যাণ সচিব রোশনী সেন বলেন, ‘‘আমার পক্ষে তো এত খুঁটিনাটি নজরে রাখা সম্ভব নয়, তবে আমরা হোমের আবাসিকদের সব টাকা ছেড়ে দিয়েছি। গত এক বছর ধরে মাসে মাথাপিছু টাকা বাড়িয়ে ২০০০ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪০০ খাবারের জন্য। বাকি ৬০০ দিয়ে আনুষঙ্গিক জিনিস কেনা যায়। তা থেকে ছেলে ও মেয়েদের অন্তর্বাস এবং মেয়েদের ন্যাপকিন কেনা হচ্ছে কিনা, সেটা সমাজকল্যাণ অধিকর্তার অফিস থেকে নিশ্চয়ই দেখা হচ্ছে।’’ সমাজকল্যাণ অধিকর্তা শুনে বলেন, ‘‘এটা নিয়ে কখনও খোঁজ নেওয়া হয়নি। মাথায় আসেনি। দেওয়া হচ্ছে মনে হয়। টাকার বরাদ্দ তো বেড়েছে।’’
যা শুনে কিশলয় হোমের সুপার প্রান্তিক ঘোষ বলেন, ‘‘কেউ খবর রাখে না। খাতায়কলমে বরাদ্দ বেড়েছে, কিন্তু সেই অতিরিক্ত টাকা আসেনি। এক বছরের বেশি সব ধারে চলছে। দু’বেলা খাবার ও টিফিন ছাড়াও আবাসিকদের ২৮৩টি প্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা রয়েছে। তার মধ্যে অন্তর্বাসও সামিল। বাড়তি টাকা না আসা পর্যন্ত সে সব কেনা যাচ্ছে না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বছরে এক বার দরপত্র ডেকে ১২ বছরের উপরের ছেলেদের জন্য একটি গেঞ্জি আর একটি জাঙ্গিয়া কেনা হয়। এতে কিছু হয়?’’ ধ্রুবাশ্রমের সুপার নীলরতন হালদারের বক্তব্য, ‘‘যা টাকা পাই, তাতে বছরে একটি অন্তর্বাস ছাড়া কিছু দিতে পারি না। একটু বড় ছেলেদের এতে খুব সমস্যা হয়। এগুলো তো মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন। সেটুকুও না পেয়ে নিজেদের অসহায়তা তারা আরও বেশি অনুভব করে। কুঁকড়ে থাকে। ওদের আত্মবিশ্বাস চিড় খায়। কিন্তু আমাদেরও উপায় নেই।’’