Advertisement
E-Paper

হস্তক্ষেপের রাস্তা কি খুললেন রাজ্যপালই

শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফেরাতে আচরণবিধির দাওয়াই চাইছে রাজ্য সরকার। যার ভিত্তি— এই মর্মে রাজ্যপালের কাছ থেকে পাওয়া সুপারিশের (বা পরামর্শ) চিঠি। কিন্তু আচরণবিধি তৈরির জন্য রাজ্য সরকার কি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়কে আদৌ নির্দেশ দিতে পারে?

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০২:২৬
সংস্কৃত কলেজের অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী।  ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

সংস্কৃত কলেজের অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা ফেরাতে আচরণবিধির দাওয়াই চাইছে রাজ্য সরকার। যার ভিত্তি— এই মর্মে রাজ্যপালের কাছ থেকে পাওয়া সুপারিশের (বা পরামর্শ) চিঠি। কিন্তু আচরণবিধি তৈরির জন্য রাজ্য সরকার কি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়কে আদৌ নির্দেশ দিতে পারে?

প্রশ্নটি ঘিরে এই মুহূর্তে রাজ্যের শিক্ষামহল তোলপাড়। শিক্ষকদের একাংশের অভিমত, সরকার এ ধরনের চিঠি বিশ্ববিদ্যালয়কে দিলে তা হবে প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপের সামিল। কেউ কেউ আবার মনে করছেন, আচার্য হিসেবে রাজ্যপাল আচরণবিধি সংক্রান্ত পরামর্শটি সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়কেই পাঠাতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে আলাপ-আলোচনা চালানো যেত, দরকার বুঝলে বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষই সেগুলো নিয়ম-বিধিতে অন্তর্ভুক্ত করে নিতেন। এতে বিতর্কের অবকাশ তেমন থাকত না বলে শিক্ষকদের অনেকের দাবি।

যেমন ‘অল বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি তরুণ নস্কর বুধবার বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণবিধি রয়েছে। বাড়তি কিছু জুড়তে হলে রাজ্যপালই উপাচার্যদের বলতে পারতেন। সেনেট-সিন্ডিকেটে আলোচনা হতে পারত। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীকে প্রস্তাব পাঠিয়ে রাজ্যপালই কার্যত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে সরকারি হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিলেন।’’ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ, ‘‘রাজ্যপাল এটা না-করলেই পারতেন। অতীতে কোনও রাজ্যপাল করেননি। কারণ, এটি সরাসরি স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ।’’ তরুণবাবুদের আশঙ্কা, সরকার এ বার নিজের মতো নিয়ম বানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাড়ে চাপাবে। হাতিয়ার করবে আচার্যের চিঠিকে।

বস্তুত রাজ্যপালের পরামর্শ সরাসরি সরকারের কাছে যাওয়ায় বিতর্কের জল ভাল রকম গড়াতে শুরু করেছে। প্রশ্ন উঠছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারকে মাথায় রেখে শিক্ষামন্ত্রী‌ই বা রাজ্যপালের প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলেন না কেন? শিক্ষক মহলের বড় অংশ এ-ও বলছেন, আচরণবিধি নিয়ে সরকারের নিজস্ব মতামত থাকলে তারা রাজ্যপালকে জানাতে পারে। সেটা না-করে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেওয়ার ভাবনাটাই অনৈতিক!

এবং এমতাবস্থায় ফের সামনে আসছে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিতর্কিত মন্তব্য। টাকার জোগানদার হওয়ার সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘরোয়া বিষয়ে হস্তক্ষেপের অধিকার সরকারের বিলক্ষণ আছে— এমনই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন পার্থবাবু। রাজ্যের শিক্ষাজগতের একাংশের ধারণা, এ হেন মনোভাবের সূত্রেই শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনা সম্পর্কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের কাছে মন্ত্রী রিপোর্ট তলব করেছিলেন। আর ওই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই তিনি রাজ্যপালের প্রস্তাব পত্রপাঠ লুফে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নিজেদের পছন্দের নিয়মে বাঁধতে উঠে-পড়ে লেগেছেন।

সরকার কী বলছে? শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য এ সব বিতর্কে বিন্দুমাত্র আমল দিচ্ছেন না। উল্টে এ দিন সংস্কৃত কলেজের এক অনুষ্ঠানে পার্থবাবুর মন্তব্য, ‘‘জোরের সঙ্গেই বলছি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আচারণবিধি দরকার। এলাম, গেলাম, কোথাও সই করলাম না। এ ভাবে হয় নাকি!’’ পার্থবাবুর বক্তব্য, ‘‘গত সাড়ে তিন দশক ধরে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা যে গড্ডলিকার মধ্যে দিয়ে চলে এসেছে, তাকে কালিমামুক্ত করতে সময় লাগবে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব।’’ প্রস্তাবিত আচরণবিধি সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী-সহ সকলের সঙ্গে আলোচনা হবে বলেও জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।

পার্থবাবুর বার্তা বিতর্কের আগুনে ঘি ঢেলেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন ‘কুটা’র এক নেতার মন্তব্য, ‘‘যে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট-সেনেটে আলোচনা হওয়ার কথা, তা নিয়ে মন্ত্রীরা আলোচনা করবেন! স্বাধিকারভঙ্গের এর চেয়ে বড় নমুনা আর কী হতে পারে?’’ রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার বলেন, ‘‘রাজ্যপাল সরকারকে উপদেশ দিতেই পারেন। কিন্তু তার প্রেক্ষিতে সরকার কখনওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে আচরণবিধি চাপিয়ে দিতে পারে না।’’ এ দিন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুটা’র বিক্ষোভ সমাবেশে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শ্রুতিনাথ প্রহরাজ অভিযোগ করেন, নতুন আচরণবিধির নামে সরকার আসলে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও আন্দোলনের অধিকার খর্ব করতে চাইছে। ‘‘সবার আগে মন্ত্রীর উচিত নিজের দলের লোকজনকে নিয়ন্ত্রণ করা। তারা যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নষ্ট না করে।’’— বলেন শ্রুতিনাথবাবু। তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘‘আচরণবিধির নামে আন্দোলন দমাতে চাইলে আন্দোলন জোরদার হবে।’’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পদে বেছে বেছে শাসকদলের অনুগতদের নিয়োগের প্রসঙ্গও এসেছে ওয়েবকুটা-র সমাবেশে। যদিও অভিযোগ মানতে চাননি শিক্ষামন্ত্রী। বাম জমানার অনুসরণে তৃণমূল আমলেও শিক্ষায় দলতন্ত্র কায়েম হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নের মুখে পড়ে মন্ত্রী এ দিন পাল্টা আঙুল তুলেছেন দুই প্রাক্তন উপাচার্যের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে। ‘‘আনন্দদেববাবু, পবিত্রবাবু, এঁরা কোন দল করতেন?’’— বলেন মন্ত্রী। একটু থেমে তাঁর দাবি, ‘‘শিক্ষক শিক্ষকই। আমরা রং দেখি না। আমরা চাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঔৎকর্ষ ও গৌরবকে রক্ষা করতে। তা-ই করা হবে।’’

মন্ত্রীর কটাক্ষ শুনে প্রাক্তন দুই উপাচার্যের কী প্রতিক্রিয়া? পবিত্রবাবু বলেন, ‘‘আমার রাজনৈতিক পরিচয় অবশ্যই ছিল। কিন্তু বর্তমানের কিছু উপাচার্যের মতো সরকারি অনুষ্ঠানে গিয়ে সরকারের স্তুতি কখনও করিনি।’’ আর আনন্দদেববাবুর
মন্তব্য, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী নিজের রুচিমাফিক কথা বলেছেন। আমি কোনও দিন কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না।’’

sanskrit college partha chattopahdyay kesharinath tripathi code of conduct student code of conduct university code of conduct university disciplines governors letter government interference
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy