তাঁর নির্বাচনী সাফল্যের অন্যতম ‘ভিত্তি’ মহিলাদের সমর্থন। সেই তিনি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার রাজ্য বাজেট সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘এই বাজেটের অর্ধেকটাই মহিলাদের জন্য।’’ মমতা প্রায়ই বলেন, মুখে অনেকে মহিলাদের ‘অর্ধেক আকাশ’ বললেও কাজে করেন না। মহিলাদের ক্ষমতায়নের ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন পদক্ষেপ করেছেন মমতা। ২০২৬ সালের ভোটের আগে শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেটেও মহিলাদের উপর গুরুত্ব আরোপের কথা উল্লেখ করলেন তিনি।
বিধানসভায় বুধবার রাজ্য বাজেট পেশ করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। তার পরে চন্দ্রিমা এবং অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অমিত মিত্রকে পাশে বসিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেই তিনি জানান, ওই বাজেটের ‘অর্ধেক’টাই মহিলাদের জন্য। প্রসঙ্গত, রাজ্য বাজেটে এ বার যে যে ক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম নারী ও শিশুকল্যাণ দফতর। বাজেটে এ-ও ঘোষণা করা হয়েছে যে, রাজ্যের ৭০ হাজার আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে (তাঁরা সকলেই মহিলা) স্মার্টফোন দেবে সরকার। তার জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটে।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
প্রশাসক হিসাবে মমতা যখনই তাঁর শাসনকালে সঙ্কটে পড়েছেন, মহিলারা তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। মহিলা ভোটারেরা তাঁকে ঢালাও ভোট দিয়েছেন। প্রতিদানে মমতাও তাঁদের ‘ঘরের মেয়ে’ হয়ে উঠেছেন। শুধু নিজে মহিলা বলেই নয়, সামগ্রিক ভাবেও মহিলাদের অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার বিষয়ে মমতা বরাবর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা-রাজ্যসভা পর্যন্ত তৃণমূলের যত মহিলা জনপ্রতিনিধি রয়েছেন, অন্য দলে এমন নজির নেই। মমতা প্রায়ই বলেন, ‘‘অন্যেরা মুখে বলে, আমরা করে দেখাই।’’ তাঁর মহিলা সমর্থনে ভাটা পড়ার একমাত্র আশঙ্কা শাসক শিবিরে তৈরি হয়েছিল আরজি কর আন্দোলনের সময়। কিন্তু তার পরেও ছ’টি উপনির্বাচনে মমতা দেখে নিয়েছেন, মহিলাদের আস্থা এবং ভরসা তাঁর উপর অটুট। অতীতের ধারা মেনে আগামী বিধানসভা ভোটেও মহিলা সমর্থনের উপর মমতার ‘ভরসা’ থাকবে। বস্তুত, নারী ক্ষমতায়নের বিষয়ে মমতা যে পদক্ষেপ করেছেন এবং করছেন, বিরোধী শিবিরও তার বিরোধিতা করতে পারছে না। কারণ, তা হলে তাদের ‘নারী ক্ষমতায়নের বিরোধী’ তকমা পেতে হয়!
ঘটনাচক্রে, বুধবারের বাজেটে মহিলাদের জন্য ‘লক্ষ্ণীর ভান্ডার’ প্রকল্পে মাথাপিছু অর্থের পরিমাণ বাড়ানো হয়নি। তবে প্রশাসনিক মহলের বক্তব্য, এত আগে থেকে ওই ঘোষণা করলে নির্বাচন আসতে আসতে তার ‘প্রভাব’ ফিকে হয়ে যেতে পারত। মমতা সেই ‘ঝুঁকি’ নেননি। মনে করা হচ্ছে, ভোট ঘোষণার আগেই তিনি ওই সংক্রান্ত ঘোষণা করতে পারেন। বাজেটে ‘লক্ষ্ণীর ভান্ডার’ প্রকল্পের মাথাপিছু অনুদান বৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্তে মমতা আরও একটি ‘বার্তা’ দিতে চেয়েছেন। তা হল: তাঁর সরকার ‘জনমোহিনী’ প্রকল্পের পাশাপাশি কর্মসংস্থান বা পরিকাঠামোর মতো বিষয়েও বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে।
আরও পড়ুন:
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের প্রচারে মমতার অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল, ক্ষমতায় ফিরলে রাজ্যের মহিলাদের ‘পকেটমানি’ দেবে সরকার। ক্ষমতায় ফেরার অব্যবহিত পরেই ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ শুরু করেন মমতা। যে প্রকল্পে বর্তমানে উপভোক্তার সংখ্যা দু’কোটি ২১ লক্ষ। মমতা বলেছেন, ‘‘ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পে সাধারণ শ্রেণির মহিলাদের জন্য অর্থ ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১,০০০ টাকা করা হয়েছে। আর তফসিলি জাতি-উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্ত মহিলারা পান ১,২০০ টাকা। এর পর বাড়বে কি না, তা সরকার ঠিক করবে।’’ মমতা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এখনই লক্ষ্মীর ভান্ডারে টাকা দিতে তাঁর সরকারকে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়।
শুধু ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ নয়। ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’র মতো প্রকল্পগুলিও মহিলাকেন্দ্রিক। কোনওটি স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের, কোনওটি বিবাহযোগ্যা মেয়েদের জন্য। আর্থিক ভাবে প্রান্তিক অংশের মেয়েদের বিবাহের জন্য রাজ্য সরকার ‘রূপশ্রী’ প্রকল্প চালু করেছিল। এই প্রকল্পে এককালীন ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। পরিসংখ্যান দিয়ে মমতা জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত সেই প্রকল্পে ১৮ লক্ষ ৬৪ হাজার মহিলা অর্থ পেয়েছেন। এ ছাড়াও বিধবাভাতা, বার্ধক্যভাতার বড় অংশ মহিলা উপভোক্তা। বাজেটে সেই অর্থেরও সংস্থান রাখা হয়েছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির উন্নয়নের জন্যও বরাদ্দ বাড়িয়েছে রাজ্য। যেগুলি মূলত মহিলাদের দ্বারাই পরিচালিত।
‘রাজনীতিক’ মমতা তো বটেই, ‘প্রশাসক’ মমতা মহিলাদের ক্ষমতায়নের প্রশ্নে গোড়া থেকেই বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ২০২৬ সালের ভোটের আগের শেষ বাজেটের অর্ধেক জুড়েও যে ‘অর্ধেক আকাশ’ রয়েছে, তা-ও স্পষ্ট করে দিলেন মমতা। প্রসঙ্গত, মহিলাদের ‘অর্ধেক আকাশ’ বলে প্রথম উল্লেখ করেছিলেন চিনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রাণ পুরুষ মাও-সে-তুং। চিন বিপ্লবের আগে মাও যে স্লোগানগুলি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে যেমন ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো’ ছিল অন্যতম, তেমনই তিনি বলেছিলেন, ‘মহিলারাই অর্ধেক আকাশ ধরে রাখেন’ (উইমেন হোল্ড আপ হাফ দ্য স্কাই)। যে স্লোগান চিনা বিপ্লবে মহিলাদের অংশগ্রহণকে গতি দিয়েছিল বলে মনে করেন ইতিহাসবিদেরা। মাওয়ের সেই কথার সূত্র ধরে নানা উপন্যাসও লেখা হয়েছে। মার্কিন সাংবাদিক নিকোলান ক্রিস্টফ এবং তাঁর স্ত্রী শেরিল উডুন মিলে লিখেছিলেন ‘হাফ দ্য স্কাই: টার্নিং অপ্রেশন ইনটু অপারচুনিটি ফর উওমেন ওয়ার্ল্ডওয়াইড’। মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে মহিলাদের জীবনের মান কেমন, সেটাই ছিল উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য। বাংলায় সুচিত্রা ভট্টাচার্যও ‘অর্ধেক আকাশ’ শীর্ষক উপন্যাস লিখেছিলেন।