অনশনের আঁচ পৌঁছে গেল দিল্লিতেও। সল্টলেকে চলতে থাকা পার্শ্বশিক্ষকদের অনশন ইস্যু নিয়ে শুক্রবার উত্তপ্ত হল সংসদ। রেবতী রাউতের মৃত্যু এবং অনশনরতদের বেশ কয়েক জনের অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা লোকসভায় তুললেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় এবং হুগলির বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। তীব্র বিরোধিতা শুরু হল তৃণমূলের তরফ থেকে। দু’পক্ষের বাগবিতণ্ডায় তুমুল হট্টগোল শুরু হয়ে গেল লোকসভায়।
পশ্চিম মেদিনীপুরের মোহনপুর ব্লকের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পার্শ্বশিক্ষিকা রেবতী রাউতের মৃত্যুকে ঘিরে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই উত্তপ্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। বেতন এবং চাকরির অন্যান্য শর্ত সংক্রান্ত মোট চার দফা দাবি নিয়ে ১১ নভেম্বর থেকে সল্টেলেকে অনশন শুরু করেছেন পার্শ্বশিক্ষকরা। পশ্চিম মেদিনীপুরের রেবতী রাউতও ১৪ নভেম্বর সেই অনশনে যোগ দিয়েছিলেন। কয়েক দিনেই তিনি গুরুতবর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে প্রথমে বিধাননগর হাসপাতালে পাঠানো হয়, সেখান থেকে এনআরএস। পরে তিনি পশ্চিম মেদিনীপুরে ফিরে যান। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর কারণ ঘিরে জোর রাজনৈতিক চাপানউতোর শুরু হয়েছে। লোকসভায় এ দিন বিজেপি-তৃণমূলের গোলমালও হল সেই নিয়েই।
শুক্রবার প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষ দিকে মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বিষয়টি প্রথমে উত্থাপন করেন। কলকাতায় পার্শ্বশিক্ষকদের অনশন চলছে, ইতিমধ্যেই এক জনের মৃত্যুও হয়েছে বলে স্পিকার ওম বিড়লাকে জানান বাবুল। বিষয়টি নিয়ে বলার অনুমতি চান তিনি। কিন্তু বাবুলকে স্পিকার জানান, বলার অনুমতি তাঁকে দিতে হলে বিরোধীদেরও দিতে হবে। বিরোধী বেঞ্চ থেকে তৃণমূলের সাংসদরাও উঠে পড়েন, বাবুলকে যাতে ওই বিষয় নিয়ে বলতে না দেওয়া হয়, সেই দাবি তুলতে থাকেন। মন্ত্রী প্রথমে থামেননি, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর এবং ইতিমধ্যেই এক জনের মৃত্যু হয়েছে— এ কথা বেশ কয়েক বার বলেন তিনি। কিন্তু বাবুল যে হেতু মন্ত্রী, সে হেতু সভার নিয়ম লঙ্ঘন না করতে তাঁকে অনুরোধ করেন স্পিকার।
আরও পড়ুন: অনশনে অসুস্থ পার্শ্বশিক্ষকের ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু, ‘ব্রেন স্ট্রোক’ আরও ১ জনের, তোলপাড় রাজ্য জুড়ে
বাবুলরা অবশ্য প্রস্তুতই ছিলেন। স্পিকারের অনুরোধের পর বাবুল মন্ত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ছেড়ে সাংসদদের জায়গায় চলে যান। তার পরে বাংলা থেকে নির্বাচিত বিজেপি সাংসদরা একসঙ্গে হইচই শুরু করেন। বিষয়টি নিয়ে বিশদে ভাষণ দিতে শুরু করেন হুগলির বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গে চলতে থাকা পার্শ্বশিক্ষকদের আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘১২ দিন ধরে অনশন চলছে, এক জনের মৃত্যু হয়েছে, আরও বেশ কয়েক জন অসুস্থ হয়েছে পড়েছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী কিছুই করছেন না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী একটা শব্দও এখনও উচ্চারণ করেননি এ বিষয়ে।’’ তৃণমূল সাংসদরা তীব্র প্রতিবাদ শুরু করেন। তখন লকেটের সমর্থনে উঠে দাঁড়ান সৌমিত্র খাঁ, সুভাষ সরকার, জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো, খগেন মুর্মু, রাজু বিস্তাদের মতো বিজেপি সাংসদরা। ‘‘কিছু করুন, না হলে পার্শ্বশিক্ষকদের এঁরা মেরে ফেলবেন,’’— স্পিকারের উদ্দেশে বার বার বলতে থাকেন লকেট। আর তাঁর সমর্থনে উঠে দাঁড়ানো অন্য বিজেপি সাংসদরা মমতার বিরুদ্ধে স্লোগান তুলতে থাকেন। তৃণমূলও সুর তুঙ্গে তোলে। ফলে হট্টগোল তীব্র হয়ে ওঠে।
দেখুন ভিডিয়ো:
পরে লোকসভা থেকে বেরিয়েও বাবুল-লকেটদের তীব্র আক্রমণ করেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা সুদীপ এ দিন স্পিকারকে চিঠি লিখেছেন। বাংলা থেকে বিজেপির টিকিটে নির্বাচিত কয়েক জন সাংসদ রোজ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের বিষয় নিয়ে লোকসভায় হইচই করছেন, লোকসভায় দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করছেন এবং এটা কিছুতেই তৃণমূল মেনে নেবে না— স্পিকারকে লেখা চিঠিতে সে কথাই জানিয়েছেন সুদীপরা। অনশনে কারও মৃত্যু হয়নি, বিজেপি সাংসদরা সংসদে মিথ্যা বলছেন— এই অভিযোগও এ দিন তুলেছেন সুদীপ।
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে অবশ্য পাল্টা আক্রমণ করেছেন বাবুল সুপ্রিয়। তিনি বলেছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে এখন যে অবস্থা চলছে, তাতে শুধু প্রতি দিন সে সব বিষয় নিয়ে সংসদে বলা যথেষ্ট নয়, সম্ভব হলে দিনে দু’বার করে বলা দরকার।’’ পার্শ্বশিক্ষকদের অনশনের বিষয়টি লোকসভায় উত্থাপন করায় তৃণমূল যে ভাবে বাধা দিয়েছে, তারও নিন্দা করেছেন বাবুল। তিনি বলেন, ‘‘সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার অনেক দিনের আলাপ। তাই বেশি কিছু বলছি না। শুধু বলছি, পার্শ্বশিক্ষকদের অনশন নিয়ে তৃণমূল কতটা অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে, লোকসভায় আমাদের বাধা দিয়ে তৃণমূল সাংসদরা নিজেরাই তা প্রমাণ করে দিয়েছেন।’’
আরও পড়ুন: সংস্কৃত পড়ান রমজান আলি, শামিম বেদান্ত দর্শন, বারাণসী শিক্ষা নেবে কি বেলুড়ের কাছে?
তবে শুধু দিল্লিতে নয়, রেবতী রাউতের মৃত্যু এবং তাপস বর-সহ অন্য কয়েক জনের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া নিয়ে সুর চড়াচ্ছে আন্দোলনকারী পার্শ্বশিক্ষক ঐক্য মঞ্চও। আজ অর্থাৎ শুক্রবার সন্ধ্যায় অনশন স্থলেই শোক দিবস পালনের ডাক দেওয়া হয়েছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে শোক পালন করা হবে বলে মঞ্চের তরফে জানানো হয়েছে।