Advertisement
E-Paper

প্রশ্ন করার স্বাধীনতায় ভর দিয়েই ইতিহাস চর্চা

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশদের মতো তার্কিকদের উপরেই আঘাত নেমে আসছে ঠিকই। তা সত্ত্বেও চিরাচরিত ভাবনাকে নিরন্তর প্রশ্ন করা এবং তর্ক চালিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতাকে হাতিয়ার করেই এগিয়ে চলবে ইতিহাসের চর্চা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:৩৫

বেদকে প্রশ্ন করেই জন্ম নিয়েছিল চার্বাক দর্শন। তর্ক, বাক্‌স্বাধীনতা, অপ্রশ্ন আনুগত্যের বদলে চিরাচরিত ভাবনাচিন্তাকে প্রশ্ন করা ভারতের বৌদ্ধিক চর্চার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশদের মতো তার্কিকদের উপরেই আঘাত নেমে আসছে ঠিকই। তা সত্ত্বেও চিরাচরিত ভাবনাকে নিরন্তর প্রশ্ন করা এবং তর্ক চালিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতাকে হাতিয়ার করেই এগিয়ে চলবে ইতিহাসের চর্চা।

বৃহস্পতিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের ৭৮তম অধিবেশনের উদ্বোধনে এই মূল সুর বেঁধে দিল ইতিহাসবিদ অধ্যাপক কৃষ্ণমোহন শ্রীমালির বক্তৃতা।

মেরুকরণের রাজনীতির জেরে ইতিহাসকে বিকৃত করার অভিযোগ বারবার উঠেছে, উঠছে। দেশের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের অনেকেরই অভিযোগ, জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে তথ্যকে বিকৃত করে ইতিহাসের হিন্দুত্বকরণের চেষ্টা চলছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম নিয়ে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার শুরুতেই শ্রীমালি মনে করিয়ে দেন ‘হেরেসি’ বা চিরাচরিত ভাবনাকে প্রশ্ন করার ঐতিহ্যের কথা। ভারতের ইতিহাস এবং সাহিত্যের ছত্রে ছত্রে যে প্রশ্ন ও তর্কের প্রভূত প্রমাণ রয়েছে, সেটাও তুলে ধরেন তিনি। বলেন, অতীতে তর্ক, বিতর্ক, কুতর্ক, ছল, জল্প এবং বিতণ্ডা— নানা ধরনের রীতি ছিল তর্কের। ইতিহাসের অনুশীলন বহমান রাখার অবলম্বন হল এই তর্ক আর প্রশ্ন।

একই সুর ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবের গলায়। তিনি বলছেন, ‘‘সঙ্ঘ পরিবারের যেমন তত্ত্ব প্রচারের অধিকার রয়েছে, তেমনই সেই তত্ত্বের বিরোধিতা করার অধিকার রয়েছে অন্যদের।’’ আলিগড়ের এই প্রবীণ ইতিহাসবিদের মতে, দেশে শুধু এক ধরনের ইতিহাস লেখা হবে, এমনটা কখনওই কাম্য নয়। কিন্তু সেই ইতিহাস যেন অবিকৃত তথ্যের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে। ইতিহাসে যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংখ্যালঘু, ব্রাহ্মণ-দলিত বিভেদ না-থাকে। একই তথ্যের উপরে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে আলাদা আলাদা ইতিহাসবিদের। এই ব্যাখ্যাকেই নিজের বক্তৃতায় তুলে ধরেন ইতিহাসবিদ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। তিনি বলেন, ‘‘ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠ হবে, একই সঙ্গে হবে ব্যক্তিনির্ভর। কোনও ইতিহাসই চূড়ান্ত নয়। ইতিহাসের ব্যাখ্যা আমাদের আপেক্ষিক সত্যের সামনে দাঁড় করায়।’’

এখানেই প্রশ্ন উঠছে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে। প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান চর্চার প্রমাণ হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর আমলে দাবি করা হচ্ছে, তখনই এরোপ্লেন আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, প্লাস্টিক সার্জারিরও জ্ঞান ছিল! তাজমহল আসলে হিন্দু মন্দির, এই তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা চলছে। এবং সেটাকেই চূড়ান্ত হিসেবে তকমা সাঁটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাবিব বলছেন, ‘‘এটা বিজেপির পুরনো কৌশল। জনগণের ভোটে জিতে এসে সেটাকেই প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।’’

এ দেশে জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলতে পাকিস্তান-বিরোধী প্রচারও বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের কৌশলের অঙ্গ। কিন্তু ইতিহাসবিদেরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সে-দেশের ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে মহেঞ্জোদাড়ো, তক্ষশীলা কিন্তু মৌলবাদী শক্তির হাত ধরেই বাদ গিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার পীঠস্থান ভারতেও তেমনটা হলে তার থেকে বড় হতাশার কিছু হবে না।

তবু এই আঁধারে স্বপ্ন দেখছেন ইতিহাসের গবেষকেরা। সেই আলোর স্বপ্নেই বক্তৃতা শেষ করেন অধ্যাপক শ্রীমালি। বললেন, ‘‘ভারতের তর্কের ঐতিহ্যই আমাদের হেরে যেতে দেবে না। আমরা গাইব, ওহ সুবহ কভি তো আয়েগি... (সেই সকাল কখনও না কখনও তো আসবেই)।’’

History Freedom of Expression Krishna Mohan Shrimali Indian History Congress কৃষ্ণমোহন শ্রীমালি Jadavpur University
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy