Advertisement
E-Paper

বাইরে নোটিস ‘হাউসফুল’

পৌষমেলায় এসে থাকার ঠাঁই নেই। চড়া দরে জেরবার পর্যটকেরা। লিখছেন আবীর মুখোপাধ্যায় ও মহেন্দ্র জেনা।মনামি চক্রবর্তী। কর্মসূত্রে বিহারবাসী। এক দিনের জন্য এসে ‘প্যাকেজ’-এর চক্করে হোটেলের ভাড়া গুনতে হয়েছিল তিন দিনের। তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার গাড়ি নিয়ে পৌঁছেছেন পৌষমেলায়। জনা পনেরোর টিমকে নিয়ে বিহারে ফিরে গেলেন রাতেই।

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:১১
লোকারণ্য। মেলায় যাওয়ার ভিড় শান্তিনিকেতনের রাস্তায়। রবিবার ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

লোকারণ্য। মেলায় যাওয়ার ভিড় শান্তিনিকেতনের রাস্তায়। রবিবার ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

মনামি চক্রবর্তী। কর্মসূত্রে বিহারবাসী। এক দিনের জন্য এসে ‘প্যাকেজ’-এর চক্করে হোটেলের ভাড়া গুনতে হয়েছিল তিন দিনের। তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার গাড়ি নিয়ে পৌঁছেছেন পৌষমেলায়। জনা পনেরোর টিমকে নিয়ে বিহারে ফিরে গেলেন রাতেই।

টানা আট বছর ধরে সপরিবারের পৌষমেলায় আসছেন দক্ষিণ দিনাজপুরের রামনাথ রবিদাস। পেশায় প্রধান শিক্ষক রামনাথবাবুর কথায়, ‘‘প্রতি বার একই হোটেলে উঠি। এত চেনাশোনার পরেও ‘প্যাকেজে’ই ঘরভাড়া নিতে হয়েছে।’’

ডিসেম্বরের শেষে শান্তিনিকেতনে পৌষমেলায় এসে কমবেশি সবারই এমন অভিজ্ঞতা হয়। এক দিনের জন্য মেলা ঘুরে দেখবেন ভেবে এসে প্রায় কোনও ঠাঁই পাবেন না। পেলেও দর শুনে দু’পা পিছিয়ে আসবেন। আর আগেই বুকিংটা সেরে নিয়ে ঝক্কি এড়াবেন বলে যদি ভাবেন, সেখানেও রয়েছে সমস্যা। মনামিদেবী বা রামনাথবাবুদের মতোই আপনাকে চড়া দাম দিয়ে রফা করতে হবে হোটেল-লজগুলির ‘প্যাকেজে’-ট্যুরেই। সাধারণ দিনের ভাড়ার চেয়ে যার রেট ৪-৫ গুণ বেশি! ভিড়ে ঠাসা মেলা দেখে হোটেলের ঘরে ফিরেও কি স্বস্তি আছে? লজ-হোটেলের পরিষেবা নিয়ে পর্যটকদের একাংশের মধ্যে একগুচ্ছ নালিশ থেকেই যাচ্ছে।

ঘটনা হল, পৌষমেলায় এ বারও ‘হাউসফুল’ বোলপুর-শান্তিনিকেতনের সমস্ত হোটেল আর লজ। বহু আগেই বুকিং শেষ অনলাইনেও। রবিবারের শেষবেলার মেলাতে ভিড়ে ভাসতে ভাসতে তাই অনেকেই খোঁজ করলেন, শহর না হোক অন্য কোথাও ঠাঁইয়ের। লজ-হোটেল-মালিকদের উদ্দেশে ‘খেউড়’ করতে করতে শেষ দিনেও জনতাকে শুধুমাত্র একরাত্রি যাপনের জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে দেখা গেল ‘হোম-স্টে’ও। ফি বছর হাউসফুলের এই ছবি অচেনা নয় বোলপুর-শান্তিনিকেতনে। এখন আর কেবল পৌষমেলা অথবা বসন্ত উৎসব নয়, ঠাসাঠাসি এই ভিড় সারা বছরের। বিশ্বভারতীর বারোমাসে তেরো পার্বণের দৌলতে দিঘা, মন্দারমণির মতো বোলপুর-শান্তিনিকেতন এখন আম বাঙালির উইকেন্ড যাপনের ঠিকানা। পর্যটকের ঢল বুঝে ফাটকা কারবার ছেড়ে হোটেল ও লজগুলি যেমন অন্য পর্যটনকেন্দ্রের মতো প্যাকেজ চালু করেছে। কেউ কেউ মনোযোগী হয়েছে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দিকেও। ‘ফাটকা’ ভাড়ার সুযোগ না থাকায়, হোটেল-লজ মালিক এবং কর্মীদের একাংশের অবশ্য একটু হলেও মন খারাপ। তাঁদের দাবি, এমনিতে পর্যটকদের জন্য যা ভাড়া, তার থেকে কোথাও তিন তো কোথাও চার গুণ, পাঁচ গুণ হয় প্যাকেজে। তবে, সেই হিসেবে গত বছরের তুলনায় এ বার ঘরভাড়া বাড়েনি বলেই তাঁদের।

এ বারের কী প্যাকেজ?

পৌষমেলায় এ বার বোলপুর-শান্তিনিকেতন হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন দু’টি প্যাকেজ করেছে। একটি ২৩-২৫ এবং অন্যটি ২৬-২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তিন দিনের এই প্যাকেজে ৩০০ টাকার রুম বেড়ে হয়েছে ১২০০-১৫০০ টাকা। অর্থাৎ প্যাকেজের জন্যে এ বারও পর্যটকদের গুনতে হয়েছে ৩৬০০-৪৫০০ টাকা। সাধারণ দিনের থেকে বহু বেশি। ভাড়া আরও বেশি মেলা প্রাঙ্গণের কাছে থাকা হোটেল ও লজগুলির। কোথাও কোথাও প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে খাওয়া-দাওয়ারও। যেখানে নেই তাদের জন্য হোটেল-রেস্তোরাঁ বা মেলার মাঠের হরেকরকমের খাবারের আয়োজনই ভরসা।

বোলপুর-শান্তিনিকেতন হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসেব অনুযায়ী এই এলাকায় প্রায় একশোর কাছাকাছি হোটেল ও লজ রয়েছে। তার বাইরেও বসতবাড়িতে অনেকেই ভাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। রয়েছে কিছু হোম-স্টেও। শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লি, সীমান্তপল্লি, পূর্বপল্লি, রতনপল্লি অথবা ক্যানাল পেরিয়ে প্রান্তিক, গোয়লাপাড়া, ফুলডাঙায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন হোম-স্টে। এসি, নন এসি এ সব হোম-স্টের কোনও কোনওটির উপরি পাওনা ঘরোয়া খাওয়াদাওয়া। চাইলে নিজেও রান্না করে নিতে পারেন। বেশির ভাগই পরিচিতদের মাধ্যমে টেলিফোনে যোগাযোগ করে বুকিং হয়। প্রতি দিন ২-৫ হাজার টাকা পর্যন্ত পড়ে। দূরত্ব বেশি হওয়ার অসুবিধাও যুক্ত হয়। এর বাইরে এলাকার উৎসব অনুষ্ঠানগুলিতে আর বছরের বাকি সময়ে থাকার জন্য রয়েছে সরকারের বেশ কিছু থাকার জায়গা। তা ছাড়াও বিশ্বভারতীর বেশ কিছু অতিথি নিবাসও রয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আওতায় থাকা ওই জায়গাগুলির বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই অনলাইনে বুকিংয়ের ব্যবস্থা করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্রভাত সরণি, সোনাঝুরি, পূর্বপল্লি, রতনপল্লি, শ্রীনিকেতন এলাকায় রয়েছে ওই সমস্ত থাকার জায়গা।

কী বলছেন পর্যটকেরা?

বোলপুর শহরের স্টেশন লাগোয়া একটি হোটেলে উঠেছেন বেহালার বাসিন্দা শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়। সপরিবারে ঘুরতে ঘুরতে দাঁড়িয়েছিলেন বিশ্বভারতীর স্টলের সামনে। তাঁর কথায়, ‘‘প্যাকেজ ব্যবস্থায় এক দিন থাকতে হলেও তিন দিনের ভাড়া গুনে দিতে বাধ্য হই। সকলের আর সাধ্যের মতো হয়ে ওঠে না। তাই ইচ্ছে থাকলেও অনেকেই কোনও মতে অনুষ্ঠান দেখে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন।’’ এই বাধ্যবাধকতা নিয়েই উত্তরবঙ্গ থেকে আট বছর ধরে মেলা দেখতে আসছেন রামনাথবাবুরা। সে ক্ষেত্রে ‘আপোসে’র মধ্যেই মেলায় সুখ খুঁজে নিচ্ছেন তাঁদের মতো অনেকেই। আর যাঁরা এক দিন অথবা দু’দিনের জন্য হোটেল ভাড়া পাচ্ছেন না, তাঁরা? মনামিদেবীর মতো রবি ঠাকুরের দেশে গাড়ি ভাড়া করে এসেই সাধ মেটাতে হচ্ছে। দিনের দিন পছন্দের অনুষ্ঠান দেখে ফিরে গিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘তিন দিনের জন্য হোটেলগুলি ৬ থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা চাইছে। তিনটি ঘর নিতেই হতো। ১৮-২১ হাজার টাকা পড়ত। তার থেকে এ ভাবে ঘোরাই ভাল।’’

গাঁটের কড়ি খরচ করেও কি স্বস্তি মিলছে? মেলায় ঘুরতে আসা তথ্য প্রযুক্তি কর্মী মৃণাল সরকার বলছেন, “দু’মাস আগে বুকিং করেও এ বার মেলা দুর্ভোগে কেটেছে। হোটেলে গিজার ছিল নামমাত্র। ঠান্ডা জলেই স্নান করতে হয়েছে। সঙ্গে বাচ্চা ছিল। জানিনা বাড়ি ফিরেই জ্বরে পড়বে কি না!” হোটেল-লজ নিয়ে একই রকম অভিজ্ঞতা বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী নবকুমার মুখোপাধ্যায়, সঞ্জয় রায়দেরও। তাঁরা জানান, নিজেরা না থাকলেও এখানে পড়ার সুবাদে পরিচিতদের অনুরোধে হোটেল বুক করে দিতে হয়। কিন্তু, ফিরে গিয়েই তাঁরা অভিযোগ করেন। কখনও খাবারের মান নিয়ে কখনও বা রুম সার্ভিস নিয়ে।

বোলপুর-শান্তিনিকেতন হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রসেনজিৎ চৌধুরীর অবশ্য দাবি, বাজারের যা দর সেই তুলনায় এলাকার হোটেল ও লজের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও এখানকার হোটেল-লজগুলি প্রায় ছ’মাস হাত গুটিয়ে বসে থাকে। ‘‘তা বলে এমনটা নয়, যে সেই ভাড়াও পর্যটকদের কাছে চাপিয়ে দেওয়া হয়। তবে, কেউ কেউ তিন গুণ, চার গুণ ভাড়া নেন। রুমের অবস্থা দেখে ওই ভাড়া নির্ধারিত হয়,’’—বলছেন তিনি।

শেষ বেলার মেলার এই ধুলোমাখা ভিড়ে ক্লান্ত হয়ে কী ভাবছেন? বসন্ত উৎসবের জন্য বুকিং সেরে ফেলবেন এই শেষ ডিসেম্বরেই!

poush mela housefull notice board purulia package
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy