সিকিম, ভাইজ়্যাগ, দিল্লি... ছাইরঙা রেফ্রিজারেটরের গায়ে একের পর এক ফ্রিজ় ম্যাগনেট সাঁটা। পাহাড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত চুম্বকদর্শন। একঝলক দেখেই বোঝা যায়, এ পরিবারে ঘুরতে যাওয়ার চল আছে। চল রয়েছে ঘুরে এসে সেই ভ্রমণের চিহ্ন যত্নে সাজিয়ে রাখারও।
কিন্তু গত পাঁচ মাসে সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। ভ্রমণ অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে বেহালার গুহ পরিবারে। মহাধুমধামের দুর্গাপুজো এখন বিস্বাদ। কয়েক হাত দূরের পুজোমণ্ডপ থেকে ভেসে আসা ঢাকের শব্দ বরং বয়ে আনছে বিষাদ। আর ঠাকুরঘরেই ঢোকেন না, উদাস গলায় জানালেন শবরী গুহ। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিদের গুলিতে নিহত সমীর গুহের স্ত্রী। পুজো নিয়ে তাঁর আর কোনও উন্মাদনা নেই। নেই ঈশ্বরে বিশ্বাসও!
ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে দেওয়ালে বসানো গণেশের মূর্তিটা। এ বাড়িতে প্রতি বছর টানা পাঁচ দিন ধরে মহাধুমধামে গণেশপুজো হত। জন্মসূত্রে মধ্যপ্রদেশের ছেলে সমীর নিজেও গণেশের ভক্ত ছিলেন। ফলে গণেশপুজো থেকেই প্রতি বার গুহদের পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে যেত। এ বার সেই পরিবারের শ্মশানের স্তব্ধতা।
পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর প্রথম যখন এই ফ্ল্যাটে এসেছিলাম, ড্রয়িংরুমের নিচু টেবিলে সমীর, শবরী আর তাঁদের কন্যা শুভাঙ্গীর ছবি রাখা ছিল। এখন সেই টেবিল প্রায় ফাঁকা! শুধু মাঝ বরাবর সমীরের একার একটা ছবি ছাড়া। সে ছবির গলায় মালা, সামনে কিছু ফুল, পাশে জ্বলছে ধূপ! আর কিচ্ছু নেই। ওলটপালট হয়ে যাওয়া গুহ পরিবারের হুবহু প্রতিচ্ছবি।
কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ছিলেন সমীর। বদলির চাকরি। কখনও দিল্লিতে, কখনও ছত্তীসগঢ়ে থাকতে হয়েছে। গত কয়েক বছরে কলকাতায় থিতু হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে বেহালার এই ফ্ল্যাটটি কিনেছিলেন। ঢোকার মুখে দরজার পাশের জুতোর তাক কৃত্রিম ঘাসে সাজানো। নেমপ্লেটে ইংরেজিতে লেখা ‘গুহজ়্’। নীচে ছোট্ট তিনটি ‘স্মাইলি’ পরিবারের তিন সদস্যের প্রতিনিধিত্ব করছে। দু’টি ফ্ল্যাট কিনে জুড়ে নিয়েছিলেন সমীরেরা। আনাচেকানাচে স্পষ্ট শৌখিনতার ছাপ। এই ফ্ল্যাটের জন্য এখনও মাসে ৪৫ হাজার টাকা করে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে, বলছিলেন শবরী। ঋণের টাকা, সংসার খরচ, সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া কন্যার পড়াশোনার খরচ, সবই যাচ্ছে সঞ্চয় থেকে। আয়ের নিশ্চিত আশ্রয় সরে যাওয়ার পরে এখনও পর্যন্ত নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারেননি মধ্যবয়স্কা শবরী। চাইছেন, যদি নিহত স্বামীর চাকরিটা পান। দিল্লির অফিসে সেই দরখাস্তও জমা দিয়েছেন। কিন্তু এখনও কেউ যোগাযোগ করেননি। কথা বলতে বলতে ক্ষোভ-হতাশা বেরিয়ে এল শবরীর কন্ঠে, ‘‘যে ঘটনার জন্য এত কিছু বদলে গেল, এত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ওলটপালট হয়ে গেল, আমরা তার ভুক্তভোগী। আমাদের সঙ্গে তো কেউ এক বার দেখাও করল না! পাঁচ মাসে কেউ খোঁজও নিতে এল না! এনআইএ থেকে অফিসারেরা এক বার এসেছিলেন। কিন্তু সে তো তদন্তের জন্য। তার পরে আর কেউ আসেননি। আমাদের কী চাই, কেউ জানতে চাননি।’’
কলকাতার এক বেসরকারি কলেজে সাইকোলজি নিয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হয়েছেন সমীরের কন্যা। কিন্তু মেয়ের পড়াশোনার ব্যয় কী ভাবে নির্বাহ করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না শবরী। ভেবে পাচ্ছেন না, এতদিনের অভ্যস্ত যাপন থেকে কী ভাবে সরে আসবেন। বললেন, ‘‘এত দিনের অভ্যাস থেকে ঝপ করে কী ভাবে নেমে আসব? মেয়েকে কী করে বলব, পছন্দের কলেজে ভর্তি হয়ো না? নিজের শখ কমিয়ে দাও?’’ তারপর স্বগতোক্তির মতো, ‘‘আর কতটা বদলে ফেলব নিজেদের?’’
ড্রয়িংরুম থেকে একটু এগিয়ে বাঁ’দিকের ছোট ঘরটাকে সমীর ‘স্টাডিরুম’ বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেখানেই মেয়েকে পড়াতেন। কখনও নিজের কাজও করতেন। স্ত্রী-কন্যা তাঁকে সঙ্গ দিতেন কখনও সখনও। তিন কাপ চায়ে জমে উঠত আড্ডা। এখন সে ঘরও খাঁ খাঁ করছে।
আরও পড়ুন:
প্রায় পরিত্যক্ত পাশের ঠাকুরঘর। লক্ষ্মী, সরস্বতী, দুর্গা, কালী, শ্রীরামকৃষ্ণ-মা সারদা-স্বামী বিবেকানন্দ— সকলের ছবি আছে মার্বেল পাথরের তৈরি আসনে। কিন্তু একটা ফুলের পাপড়িও নেই!
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন না? শবরী দীর্ঘশ্বাস চেপে বললেন, ‘‘নাহ্, কী হবে করে? আমার আর বিশ্বাস হয় না। উনি তো এত পুজোআচ্চা করতেন। এত ভক্তি ছিল। ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার দিনও তো হনুমান চালিসা পড়ে বেরিয়েছিলেন।’’ কিছুটা থেমে, ‘‘যদি কখনও পরিস্থিতি বদলায়, যদি কখনও বিশ্বাস ফিরে পাই, তখন আবার পুজো করব।’’
একাকী জীবনের সঙ্গে এখনও ধাতস্থ হতে পারেননি শবরী। নিজের হোয়াটস্অ্যাপে এখনও স্বামীর সঙ্গে ছবি। কথা বলতে বলতে যখন তখন চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। অবচেতনেও হয়তো খোঁজেন সেই সঙ্গীকে, যাঁকে স্বামী কম, বন্ধু হিসাবে বেশি দেখতেন। যে কোনও কঠিন সময়ে পরস্পরকে আঁকড়ে থাকতেন। শবরীর কথায়, ‘‘আমার স্বামী আমার বন্ধু ছিল। সব কথা ওকে বলতাম। এখন আমার জীবনে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে, এত যে কষ্ট হচ্ছে আমার, সেটা ভাগ করে নেওয়ার জন্যেও ওকে পাচ্ছি না!’’
নিয়মিত বেড়াতে গেলেও পুজোয় কোথাও যেতেন না সমীর। অবশ্য পুজোয় সে ভাবে ছুটিও পেতেন না। পুজোর দিনগুলোয় অফিস থেকে ফিরে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে কলকাতার ঠাকুর দেখতে বেরোতেন। এ বছর পুজোয় কোথায় কী ‘থিম’ হয়েছে, জানেন না শবরী। তবে তিনি নিশ্চিত, পহেলগাঁওয়ের ঘটনা অনেকের মাথাতেই এসেছে। বললেনও যে, ‘‘এ বার নিশ্চয়ই প্রচুর পহেলগাঁও থিম হবে। শুধু আমাদের জীবনের থিমটাই বদলে গেল!’’
ধার্মিক মানুষ ছিলেন সমীর। সেই সঙ্গে পারিবারিক। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়েই ছিল তাঁর জগৎ। কাজের বাইরে বাকি সময়টুকু পরিবারের সঙ্গেই কাটাতেন। নিজে ঘুরতে ভালবাসতেন। মেয়ে স্কুল থেকে একটু লম্বা ছুটি পেলেই চার-পাঁচ দিনের ‘ট্যুর’ ছকে ফেলতেন। অনেক আগেই কাশ্মীরে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। নানা কারণে তা এক-দেড় বছর পিছিয়ে যায়। ভূস্বর্গে বসেই পরের ছুটিতে কেরলে যাওয়ার পরিকল্পনাও করে ফেলেছিলেন। কোথাও ঘুরতে গেলে আলাদা করে পেশাদার ক্যামেরাম্যান দিয়ে ছবি তোলাতেন। ছোট ছোট ‘রিল’ বানাতেন। সেই ক্যামেরাই কাল হল সমীরের জীবনে! পহেলগাঁওয়ের পাহাড়ের কোলে সবুজ উপত্যকায় দাঁড়িয়ে স্ত্রীকে পাশে নিয়ে ছবি তোলাচ্ছিলেন মেয়ে শুভাঙ্গীর হাতে ক্যামেরা দিয়ে। তখনই আচমকা ছুটে আসে গুলি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সমীর।
আর ওঠেননি। চিরকালের মতো ছবি হয়ে গিয়েছেন।
সেই ছবি আঁকড়ে চাকরির আশায় দিন গুনছেন শবরী। মহাষষ্ঠীর বোধনে পুজো শুরুর লগ্ন এগিয়ে আসছে। বেহালার জগৎ রায়চৌধুরী রোডের এই বাড়ির চৌকাঠে থমকে গিয়েছে মায়ের বোধন। থমকে গিয়েছে পুজোর জৌলুস।