Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দাম মিলছে না, মাথায় হাত হাওড়ার পানচাষির

ফলন দেখে তাঁদের মুখে হাসি ফুটেছিল। কিন্তু পানের দাম কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে গিয়েছেন হাওড়া জেলার পানচাষিরা। জেলার চাষিরা বাগনান এবং উলুবেড়িয়ার খলিসানি-কালীতলা এই দু’টি আড়তে পান বিক্রি করেন। দু’টি আড়তে বিভিন্ন জেলা এবং রাজ্য থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন। সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে পান কিনে নিয়ে যান।

চলছে ভাল-খারাপ পাতার বাছাই। জগৎপুরে সুব্রত জানার ছবি।

চলছে ভাল-খারাপ পাতার বাছাই। জগৎপুরে সুব্রত জানার ছবি।

নুরুল আবসার
উলুবেড়িয়া শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৫ ০১:৫৩
Share: Save:

ফলন দেখে তাঁদের মুখে হাসি ফুটেছিল। কিন্তু পানের দাম কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে গিয়েছেন হাওড়া জেলার পানচাষিরা।

জেলার চাষিরা বাগনান এবং উলুবেড়িয়ার খলিসানি-কালীতলা এই দু’টি আড়তে পান বিক্রি করেন। দু’টি আড়তে বিভিন্ন জেলা এবং রাজ্য থেকে ব্যবসায়ীরা আসেন। সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে পান কিনে নিয়ে যান। দু’টি আড়তেই ব্যবসায়ীদের আসা কমেছে। যাঁরা আসছেন, তাঁরা আবার বেশি দাম দিতে রাজি হচ্ছেন না। যেন দাম কমানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। পান সাধারণত ‘মোট’ হিসাবে বিক্রি হয়। একটি ‘মোটে’ ১০ হাজার পান থাকে। গত বছর পর্যন্ত যেখানে চাষিরা মোটপিছু দাম পেয়েছেন দু’হাজার টাকা, এ বারে তা নেমেছে ৩০০-৫০০ টাকায়।

তবে, ঠিক কী কারণে এ বার পানের দাম পড়ল তা নিয়ে নানা মত শোনা যাচ্ছে চাষি ও ব্যবসায়ী মহলে। দুই আড়তের ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ মনে করছেন, পান খাওয়ার প্রবণতা কমছে। বদলে বাড়ছে গুটখা বা পান মশলার চাহিদা। তাই পানের চাহিদা কয়েক বছর ধরেই ধীরে ধীরে কমছিল। এ বছর তা চরমে উঠেছে। বর্ধমানের মেমারি থেকে আসা গৌতম হাজরার কথায়, ‘‘গুটখা বা পান মশলা খাওয়া যত বাড়বে, পানের চাহিদা ততই কমবে।’’ ঝাড়খণ্ডের দুমকার ব্যবসায়ী রঞ্জিত চৌরাসিয়া বলেন, ‘‘আমরা বিভিন্ন পানের দোকানে পান পাঠাই। তাঁরাই আমাদের জানাচ্ছেন, কোনও খরিদ্দার এক সময়ে যেখানে দিনে ১০ খিলি পান খেতেন, এখন তিনি খাচ্ছেন এক খিলি।। বদলে নিচ্ছেন ১০টি গুটখার প্যাকেট।’’ কেউ কেউ অবশ্য মনে করছেন, বেশি ফলনের জন্য দাম কমছে।

হাওড়ায় পান অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। চাষিরা বাজারে পান বিক্রি করে সংসারে নগদ অর্থের আমদানি ঘটান। জেলায় পান চাষ হয় মূলত উলুবেড়িয়া, বাগনান এবং আমতায়। জেলা উদ্যানপালন দফতর সূত্রের খবর, এখানে ৩ হাজার ৫৯৫ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়। গত বছরে ১২ লক্ষ ৮৩ হাজার ৫৭৬ মোট পান উৎপাদন হয়েছে। এ বছরের হিসাব এখনও মেলেনি।

চাষিরা জানান, এক বিঘা জমিতে পান চাষ করতে হলে প্রস্তুতি নিতে হয় অন্তত দু’বছর ধরে। প্রথমে মাটি ফেলে জমি উঁচু করতে হয়। তারপরে বাঁশ, খড়ি ও পাঁকাটি দিয়ে বরোজ তৈরি করতে হয়। বরোজে খড়ি ও পাটকাঠির ছাউনি দিতে হয়। যাতে বৃষ্টির জল পুরোটাই সরাসরি ভিতরে না-ঢোকে। এবং তা মাটিতে দাঁড়িয়ে না যায়। এক বিঘা জমিতে বরোজ তৈরি করতে খরচ হয় অন্তত ৭০ হাজার টাকা। তার ভিতরে পানের চারা রোপণ করতে হয়। প্রথম বছরে শুধু গাছগুলিকে তৈরি করতে হয়। পরের বছর থেকে কিছু পান ফলতে শুরু করে। তা বিক্রি করে অবশ্য চাষিদের লাভ হয় না। তবে, সার ও কীটনাশকের দাম উঠে যায়। দু’বছর পর থেকে বিক্রির জন্য পান ফলতে শুরু করে। ঠিকমতো দেখভাল করলে একটি বরোজ থেকে টানা ৮-১০ বছর পান পাওয়া যায়।

পান প্রায় সারা বছর ফললেও বর্ষাতেই ফলন ভাল হয়। শীতকালে তেমন ফলে না বললেই চলে। সেই সময় পানের জোগান অব্যাহত রাখার জন্য তার মাস দুই আগে থেকে চাষিরা পান তোলা বন্ধ করে দেন। সেই না-তোলা পান শীতের মরসুমে তোলা হয়। এই পানকে বলা হয় ‘পুরনো পান’। জোগান কম থাকার জন্য শীতের মরসুমে চাষিরা পানের দাম ভাল পেয়ে থাকেন। মার্চ-এপ্রিল মাস থেকে শুরু হয় পানের বেশি ফলন। এই পান ‘নতুন পান’ বলে পরিচিত।

এ বছর পুরনো বা নতুন কোনও পানের দামই পাচ্ছেন না চাষিরা। বাগনানের খাদিনান গ্রামের চাষি সীতারাম জানা বলেন, ‘‘একটি মোট তৈরি করতে মজুরি পড়ে ৬৫০ টাকা। সেই পান বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়। অথচ গত বছরেও পানের মোটপ্রতি দাম পেয়েছি ২০০০ টাকা করে।’’ একই বক্তব্য উলুবেড়িয়ার জগৎপুরেরর সনৎ বাগ এবং তপন মান্না নামে দুই পান চাষির। খলিসানি-কালীতলার আড়তদার অপূর্ব দলপতি বললেন, ‘‘এত বছর ব্যবসা করছি। বাজারের এই রকম শোচনীয় অবস্থা কোনও দিন দেখিনি।’’ তবে, পানের দাম কেন কমল তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছুই বলতে পারলেন না অপূর্ববাবু।

তবে, পানের দাম পড়লেও আশা ছাড়েননি চাষিরা। নিজেদের বাড়িতে বসে পানের গোছা তৈরি করতে করতে সনৎবাবু ও তপনবাবু বললেন, ‘‘পানের মৌতাত আলাদা। গুটখা ছেড়ে মানুষ পানেই ফের ফিরবেন। সেই আশাতেই চাষ করছি আমরা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE