E-Paper

আগুন আমাদের সব কেড়ে নিলেও পরীক্ষা কিন্তু আমি দেবই

আমাদের সর্বহারা বস্তিতে আগুন লেগেছে। শুনেই বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। ছুটে স্যরের বাড়ির ছাদে গিয়ে দেখি, বস্তির ঠিক মাথার আকাশটা টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে।

নন্দিনী যাদব (মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী)

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৬:৫৮
An image of the person

অসহায়: ভস্মীভূত ঘরে পোড়া বইখাতার খোঁজে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী নন্দিনী যাদব। বুধবার, হাওড়ায়। —নিজস্ব চিত্র।

সপ্তাহে তিন দিন ইছাপুরে এক শিক্ষকের বাড়িতে ইংরেজি ও অঙ্ক শিখতে যাই। মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেও গিয়েছিলাম। সেখানে বসেই খবর পাই যে, আমাদের সর্বহারা বস্তিতে আগুন লেগেছে। শুনেই বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। ছুটে স্যরের বাড়ির ছাদে গিয়ে দেখি, বস্তির ঠিক মাথার আকাশটা টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গে কালো ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠছে উপরে। ওই দৃশ্যের পরে আর সময় নষ্ট করিনি। বইখাতা নিয়ে ছুটেছিলাম বস্তির ঘরের দিকে।

এর পরে চোখের সামনে যা দেখলাম, তা বর্ণনা করার মতো শক্তি আমার নেই। ড্রেনেজ ক্যানাল রোডের উপরে তখন আগুন দেখতে আসা লোকের ভিড়। সেই ভিড় ঠেলে কোনও রকমে বস্তির সামনে যেতেই দেখি, আমাদের পরিবারের আশা-ভরসা, মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু দাউদাউ করে জ্বলছে। চোখের সামনে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল আমার সব স্বপ্ন। ঘোর কাটতেই প্রথম চেষ্টা ছিল, জ্বলন্ত ঘর থেকে যদি কিছু বার করে আনতে পারি। কিন্তু আমি কেন, কাউকেই ওই লেলিহান আগুনের ধারকাছে যেতে দেয়নি পুলিশ। দূর থেকে শুধু দাঁড়িয়েই দেখলাম, গোটা বস্তির সঙ্গে পুড়ছে আমার ঘর, আমার খাতা-বইপত্র, স্কুলের আইডেন্টিটি কার্ড আর তিল তিল করে বাবা-মায়ের সাজানো সংসার।

জন্ম থেকেই আমি এই বস্তির বাসিন্দা। একটি মাত্র ঘরে বাবা, মা ও ভাইকে নিয়ে চার জনের সংসার। বাবা শম্ভু যাদব হাওড়া জেলা হাসপাতালে ঝাড়ুদারের চাকরি করেন। মা দুর্গা যাদব পরিচারিকার কাজ করেন। ভাই পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরি শিক্ষা নিকেতন গার্লস হাইস্কুল থেকে আমি এ বারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। আর মাত্র দু’মাস বাকি পরীক্ষার। এরই মধ্যে মাথার ছাদটুকু চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে, আমার সব কিছু শেষ হয়ে গেল।

তবে এক রাতেই আমি মনস্থির করে নিয়েছি, আগুন আমাদের সব কেড়ে নিলেও পরীক্ষা কিন্তু আমি দেবই। মঙ্গলবার রাতে বস্তির আশ্রয়হীন সকলের যে স্কুলে ঠাঁই হয়েছিল, সেখানে সারা রাত কাটানোর পরে সকাল হতেই ঠিক করলাম, স্কুলে যাব। দিদিমণিদের সব বলব। আজ স্কুলেও গিয়েছিলাম। দিদিদের কাছে সব কথা খুলে বললাম।

সব শুনে দিদিরা যে ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, সেই ঋণ এ জীবনে শোধ করতে পারব না। সমস্ত বই পুড়ে গিয়েছে শুনে স্কুল থেকে যাবতীয় সরকারি বই এবং অন্য বই জোগাড় করে দেওয়া হল। এ ছাড়াও বইখাতা কেনার জন্য প্রধান শিক্ষিকা দিদিমণি আমার হাতে এক হাজার টাকা দিয়েছেন। আমার স্কুলের পোশাক, জামা-প্যান্ট, আধার কার্ড, জন্মের শংসাপত্র পুড়ে গিয়েছে শুনে দিদিমণিরাই নতুন জামা, সালোয়ার দিলেন। আর কিছু প্রয়োজন হলেও জানাতে বলেছেন।

এ ভাবে স্কুলকে পাশে পাব, ভাবিনি। তাই আমাদের অস্থায়ী ঠিকানায় ফিরেও ঘোরের মধ্যে ছিলাম। শুনলাম, কয়েক জন শুভানুধ্যায়ী এসে বাবা-মাকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন। জানি না, পড়াশোনা চালাতে আর কে, কী ভাবে আমাকে সাহায্য করবেন। তবে নিজের স্কুল থেকে যে সাহায্য আমি পেয়েছি, তার প্রতিদান দিতে চাইলে আমাকে পড়াশোনা চালিয়ে নিজের পায়ে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Fire Accident Howrah Board Examination school student

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy