উপরে বাঁ দিকে, কাজে ব্যস্ত কারিগরেরা। নীচে বাঁ দিকে, গঙ্গারামপুর বাজারে বিক্রি হচ্ছে শাড়ি।
উলুবেড়িয়া শহরের বুকে যেন এক টুকরো বড়বাজার!
ঠিক বড়বাজারেরই আদলে শহরের গঙ্গারামপুরে ওটি রোডের ধারে সার দিয়ে একের পর এক জরির দোকান। সংখ্যায় অন্তত ১৮০। শো-কেসে থরে থরে শাড়ি, মেয়েদের স্যুট, চুড়িদার। সামান্য খুঁত তুলে বড়বাজারের ব্যবসায়ীরা যে সব জরির কাজ বাতিল করে দেন, তা-ই প্রায় বছর তিনেক আগে গড়ে ওঠা ওই বাজারে জায়গা করছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বড়বাজারে যাঁরা জরির পণ্য কিনতে আসেন, তাঁরাই আবার চলে আসছেন গঙ্গারামপুরে।
ধীরে ধীরে গঙ্গারামপুর বাজারের জরি-পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। স্থানাভাবে দোকানের জায়গায় মাথা তুলছে বহুতল বাজার চত্বর। তাতে স্টল কিনে বা ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাই প্রোমোটারেরাও এখন বহুতল বাজার তৈরিতে নেমে পড়েছেন। ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব, সরকার যদি সাঁকরাইলের বদলে এই এলাকায় জমি কিনে জরি-হাব তৈরি করে এবং ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা দেয় তা হলে শুধু বাতিল পণ্য কেনা-বেচা নয়, আক্ষরিক অর্থেই বড়বাজারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে গঙ্গারামপুর।
হাওড়ার উলুবেড়িয়া, পাঁচলা, সাঁকরাইল প্রভৃতি এলাকায় ঘরে ঘরে জরির কাজ হয়। লক্ষাধিক মানুষ এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাই হাওড়ায় একটি জরি-হাব তৈরির দাবি জরি ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের। বছর তিনেক আগে সাঁকরাইলে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের জমিতে তৈরি একটি ভবনে জরি-হাবের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কথা ছিল, এখানে যেমন ভিন্ রাজ্যের ক্রেতারা আসবেন, তেমনই কারিগর-ওস্তাগরদের স্টল থাকবে। বড়বাজারের বিকল্প হয়ে উঠবে এই হাব। কিন্তু এখনও তা খাঁ খাঁ করছে। রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের দাবি, এই জরি-হাবে কী পদ্ধতিতে ব্যবসায়ীদের স্টল দেওয়া হবে, সে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত না হওয়ায় তা চালু করা যাচ্ছে না।
অথচ, গঙ্গারামপুরে একই বাজার বেসরকারি উদ্যোগে তৈরি হয়ে রমরমিয়ে চলছে। ব্যবসায়ীরা এখানে জরি-হাব তৈরির যে প্রস্তাব তুলছেন, তাকে স্বাগত জানিয়েছেন উলুবেড়িয়া দক্ষিণ কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক পুলক রায়। তিনি বলেন, “সাঁকরাইলে জরি হাব চালুর চেষ্টা চলছে। তবে, গঙ্গারামপুরে যেহেতু ইতিমধ্যে বাজার গড়ে উঠেছে তাই এখানে আরও উন্নত মানের কিছু তৈরির জন্য ব্যবসায়ীরা যদি প্রস্তাব দেন, সরকারের নির্দিষ্ট দফতরে তা নিয়ে আলোচনা হবে।”
জরি ব্যবসাটি ‘ওস্তাগর’ নির্ভর। ওস্তাগর নিজস্ব ডিজাইন দেখিয়ে কলকাতার বড়বাজার থেকে শাড়ি, চুড়িদার, লেহঙ্গা-চোলি এমনকী মেয়েদের জরি বসানো স্যুটেরও বরাত বরাত সংগ্রহ করেন। ব্যবসায়ীরাই সাধারণত কাপড়টি দিয়ে দেন। চুমকি, কসব, সলমা প্রভৃতি উপকরণ ওস্তাগরেরাই কিনে কারিগরের হাতে তুলে দেন। গ্রাম-গঞ্জে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে অসংখ্য কারিগর ওস্তাগরের দেওয়া নকশার উপরে জরির কাজ করেন। কাজ শেষে তা নিয়ে ওস্তাগর বড়বাজারের ব্যবসায়ীর কাছে যান। ব্যবসায়ী কাপড়ের দামটুকু বাদ দিয়ে জরির কাজের বিভিন্ন উপকরণ এবং মজুরি মিটিয়ে দেন। ওস্তাগর নিজের লাভ রেখে মজুরির টাকা কারিগরদের মধ্যে বন্টন করেন।
ওস্তাগরদের একাংশের অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই গুণমান নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে বড়বাজারের ব্যবসায়ীরা কাজের অন্তত ২৫ শতাংশ বাতিল করে দেন। অবশ্য ওই বাতিল কাজও ওই ব্যবসায়ীরাই কেনেন। কিন্তু এর জন্য অর্ধেক বা তারও বেশি মজুরি তাঁরা কেটে নেন। এতে ওস্তাগর ছাড়াও কারিগরেরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
ডান দিকে ব্যবসায়ীদের উদ্যোগেই তৈরি হচ্ছে জরি বাজার।
ওস্তাগরদের দাবি, বাতিল মানে ওই সব পণ্য সামান্য খুঁতযুক্ত। তাই ক্ষতি থেকে বাঁচতে তাঁরাই গঙ্গারামপুরে বাজটি তৈরি করেন বছর সাতেক আগে। সরকারের কোনও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই। হাজার হাজার মানুষের রুজি-রোজগারের সংস্থান হচ্ছে এই বাজার থেকে। একদিকে যেমন জেলার নানা প্রান্তের ওস্তাগরেরা তাঁদের তৈরি পণ্য নিয়ে বিক্রির জন্য হাজির হচ্ছেন এই বাজারে, অন্য দিকে হায়দরাবাদ, মুম্বই, বেঙ্গালুরু থেকে নিয়মিত ক্রেতারা আসছেন এখান থেকে সওদা করতে।
বাজারের প্রতিষ্ঠাতা বলে নিজেকে দাবি করে ব্যবসায়ী প্রদীপ ঘোষ বললেন, “বড়বাজারের বঞ্চনা থেকেই আমরা এই বিকল্প বাজার তৈরির পরিকল্পনা করি। আমিই প্রথম দোকান করি। বড়বাজারে যে সব জরির কাজ বাতিল করা হয় আমরা ওস্তাগরদের বলি ওখানে কম দামে সেগুলি বিক্রির দরকার নেই। ন্যায্য দাম দিয়ে আমরাই এগুলি কিনে নিই।” ওই বাজারের ব্যবসায়ীদের দাবি, এরই মধ্যে দেশের নানা প্রান্তে এই বাজারের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। ক’দিন আগেই একটি দোকানে দেখা হল অনিতা রানি, বর্ষা রানির সঙ্গে। দু’দিন আগে হায়দরাবাদ থেকে তাঁরা এসেছিলেন। দু’জনেই বলেন, “আমরা আগে বড়বাজারেই যেতাম। এখন এখান থেকেই পণ্য কিনি। তা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বিক্রি করি।”
গঙ্গারামপুরের বাজার হাসি ফুটিয়েছে জরির কারিগরদের মুখে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy