অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছে না তৃণমূল বা বিজেপি। কিন্তু দুই দলই একটু চমকিত! গত পঞ্চাশ বছরে কংগ্রেসের দিকে মুখ তুলে চায়নি যে এলাকা, সেই ‘মতুয়াদুর্গ’ থেকে ২৫ জন বিহারে গিয়ে ‘আপৎকালীন ভিত্তিতে’ রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছেন। কংগ্রেসে যোগও দিতে চেয়েছেন। বনগাঁর ওই মতুয়া প্রতিনিধিদলের সঙ্গে রাহুলের যোগাযোগের মাধ্যম অধীররঞ্জন চৌধুরী। তিনি অবশ্য দাবি করছেন না যে, বনগাঁ-রানাঘাটে অবিলম্বে কংগ্রেসের ‘পুনরুত্থান’ ঘটতে চলেছে। তবে মতুয়াভুমে আচমকা তৈরি হওয়া কংগ্রেস-পদচিহ্ন আকারে ছোট হলেও নানা মহলে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।
গত বছর দশেকের ছবি বলছে, মতুয়া অঞ্চলে বিজেপি ছাড়লে তৃণমূল আর তৃণমূল ছাড়লে বিজেপিই গন্তব্য। সেখানে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার জন্য এমন ‘তৎপরতা’ কেন? প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর বলছেন, ‘‘যাঁরা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তাঁরা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রথমে আমাদের কয়েকজন স্থানীয় কর্মীর সঙ্গে ওঁরা কথা বলেন। তার পরে আমাদের রাজ্য স্তরের মুখপাত্র কেতন জায়সওয়াল বনগাঁয় গিয়ে ওঁদের সঙ্গে দেখা করেন। কেতনের সঙ্গেই ওঁরা আমার কাছে আসেন। তাঁরা বলছিলেন, এসআইআর (ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা) নিয়ে এলাকার মানুষ চিন্তায় রয়েছেন। বিজেপি বা তৃণমূলের উপরে তাঁদের ভরসা নেই। তাই কংগ্রেসের সঙ্গে থাকতে চান।’’
মতুয়া প্রতিনিধিদলটি কংগ্রেসে যোগ দিতে চায় জেনে প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন অধীর। কিন্তু তাঁরা সরাসরি রাহুলের সঙ্গেই দেখা করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। অধীর সেই ব্যবস্থা করে দেন।
বনগাঁ উত্তর বিধানসভা এলাকার সাধারণ বিজেপি কর্মী তপন হালদার আর তাঁর সঙ্গীদের জন্য প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি অধীর যে রকম ‘তৎপরতা’ দেখিয়েছেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ। তপনের সঙ্গে বনগাঁয় কেতনের বৈঠক হয় ২৪ অগস্ট। ২৬ অগস্ট তাঁরা বহরমপুরে গিয়ে অধীরের সঙ্গে দেখা করে রাহুলের সঙ্গে দেখা করতে চান। রাহুল তখন বিহারে ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’য়। সেই যাত্রায় রাহুলের অন্যতম সঙ্গী তথা বিহারের কংগ্রেস সাংসদ অখিলেশপ্রসাদ সিংহকে ফোন করেন অধীর। যোগাযোগ করেন এআইসিসির সাধারণ সম্পাদক কেসি বেণুগোপালকেও। রাহুলকেও হোয়াটসঅ্যাপে বিষয়টি জানিয়ে রাখেন। সময় বার করা রাহুলের পক্ষে কঠিন হচ্ছিল। তাই বার্তা আসে, বিহারে ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’ শেষ হওয়ার পরে দিল্লিতে রাহুল দেখা করবেন মতুয়া প্রতিনিধিদের সঙ্গে। অধীরের কথায়, ‘‘কিন্তু ওঁরা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে অবিলম্বে দেখা করতে চাইছিলেন। ওঁদের উৎসাহ দেখে আমি কেতনের সঙ্গে ওঁদের বিহারে পাঠিয়ে দিই।’’
২৯ অগস্ট তাঁরা বিহার রওনা হন। সে রাতে রাহুলের যাত্রা শেষ হয় সারণ জেলার একমা গ্রামে। পর দিন সকালে একমা থেকে যাত্রা শুরু হওয়ার আগে আবার অধীর রাহুলকে জানান, মতুয়া সমাজের প্রতিনিধিদল তাঁর নৈশকালীন শিবিরের সামনেই অপেক্ষা করছে। সকাল ৯টায় প্রতিনিধিদলটির সঙ্গে রাহুল বৈঠকে বসেন। কেতনের কথায়, ‘‘রাহুলজির সঙ্গে ওঁদের মিনিট ২০ কথোপকথন হয়। মতুয়া সমাজের সমস্যা এবং সংগ্রামের বিষয়ে রাহুলজি কিছু কথা জিজ্ঞাসা করেন। তার পরে বলেন, দিল্লিতে আবার তাঁদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। দিনক্ষণ অধীর চৌধুরীর মাধ্যমে জানিয়ে দেবেন।’’
যাঁরা রাহুলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তাঁরা ‘প্রভাবশালী’ নন। তাঁদের ভাঙিয়ে নিলে বিজেপির বিরাট ক্ষতি আর কংগ্রেসের দারুণ লাভ, তেমনও নয়। তবু এত ‘তৎপরতা’ কেন? অধীর নিজে মতুয়া প্রতিনিধিদলটির ‘উৎসাহের’ কথাই বলছেন। কিন্তু তিনি নিজে কোনও ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ গন্ধ না-পেলে আর্জি পাওয়ার মাত্র তিন দিনের মধ্যে সরাসরি রাহুলের সঙ্গে বনগাঁর তপনদের দেখা করিয়ে দিতেন না।
ঘটনাটি নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে। বিজেপির বনগাঁ সাংগঠনিক জেলা সভাপতি বিকাশ ঘোষ বলছেন, ‘‘তপন হালদারকে আমরা শোকজ় করব। বিজেপি কর্মী হয়ে তিনি কেন রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন জানতে চাইব।’’ তপন দলের কোনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নেই বলে বিকাশ জানাচ্ছেন। তবু তাঁকে শোকজ় করার কথা বিজেপিকে ভাবতে হচ্ছে। ঘটনার অভিঘাত তাতেই স্পষ্ট। মতুয়া ঠাকুরবাড়িও বিষয়টি সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারেনি। ঠাকুরবাড়ির তরফে দাবি করা হয়েছে, ‘‘মতুয়া মেলায় নিয়ে যাওয়ার নাম করে রাহুল গান্ধীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।’’ বিহার থেকে ফিরে দু’জন মতুয়াভক্ত সত্যিই তেমন বয়ান দিয়েছেন। কিন্তু কংগ্রেস মুখপাত্র কেতন যে ছবি দেখাচ্ছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, হাওড়া স্টেশনের বাইরে ব্যানার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রতিনিধিদলটি। সে ব্যানারে রাহুলের ছবি তো রয়েছেই। সঙ্গে লেখা রয়েছে, ‘এসআইআর-এ বিপদ / কংগ্রেসে নিরাপদ’।
তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশ এই ঘটনার জন্য মতুয়া ঠাকুরবাড়ির ‘অভ্যন্তরীণ বিবাদ’কে দায়ী করছেন। গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত ও পরিবহণ কর্মাধ্যক্ষ তথা তৃণমূল যুব কংগ্রেসের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক নিরুপম রায় বলছেন, ‘‘দু’টি রাজনৈতিক দলে ভাগ হয়ে ঠাকুরবাড়ির কয়েকজন যে ভাবে নিজেদের স্বার্থে ভক্তদের ব্যবহার করছেন, তাতে বিরক্ত হয়ে কয়েকজনের হয়তো মনে হয়েছে যে, কংগ্রেসের কাছে গেলেই ভাল হবে।’’ তবে এতে কংগ্রেসের কোনও লাভ হবে নিরুপম মনে করছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক বলে কিছু হয় না। ও সব ঠাকুরবাড়ির কেউ কেউ দাবি করেন। ও রকম কিছু নেই। এই অঞ্চলে বিজেপি ভোট পায়। কারণ, পূর্ববঙ্গ থেকে আসা লোকজনের একটা বড় অংশ বিজেপিকে ভোট দেয়। এই এলাকার মানুষের জন্য প্রকৃত কাজ যিনি করেছেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই মানুষ তৃণমূলকেও বড় সংখ্যায় ভোট দেয়। তার বাইরে কিছু নেই।’’
মতুয়া সমাজ ও উদ্বাস্তু আন্দোলন সংক্রান্ত বিষয়ের এক গবেষকের ব্যাখ্যা কিন্তু অন্য রকম। তিনি ঠাকুরবাড়ির ‘ঘনিষ্ঠ’ হওয়ায় প্রকাশ্য মন্তব্যে নারাজ। তবে তাঁর মতে, ‘‘বিজেপি এবং তৃণমূল, দু’দলের প্রতিই অনাস্থা তৈরি হলে এই অঞ্চলে স্বাভাবিক পছন্দ হিসেবে কংগ্রেসের কথাই মাথায় আসবে। কারণ, পূর্ববঙ্গ থেকে এ বঙ্গে মতুয়া সমাজকে নিয়ে এসে যিনি সংগঠিত করেছিলেন, সেই প্রমথরঞ্জন ঠাকুর কংগ্রেস করতেন। বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীও ছিলেন।’’ ওই গবেষকের কথায়, ‘‘পিআর ঠাকুরের পরবর্তী যুগে কংগ্রেস আর ওই এলাকায় সে ভাবে মাথা তুলতে পারেনি। বরং গত দশ বছরে তৃণমূল এবং বিজেপি থেকেই ঠাকুরবাড়ির মাথারা বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু পুরনো দিনের কংগ্রেস আবেগ সেখানকার পুরনো মানুষদের একাংশের মধ্যে এখনও কাজ করে।’’