Advertisement
০৫ মে ২০২৪
ED Attacked in Sandeshkhali

কী লুকোতে এমন হামলা? প্রশ্ন আর সন্দেহ বাড়ছে ইডির, চলছে নতুন পথের খোঁজ শাহজাহান-অভিযানে

শুক্রবার সকাল ৭টা নাগাদ সন্দেশখালির সরবেড়িয়া গ্রামে তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে গ্রামবাসীদের একাংশের হামলার মুখে পড়ে ইডি। তা নিয়ে দিনভর তোলপাড় রাজনীতি।

তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখের বাড়িতে গিয়ে আক্রান্ত ইডি আধিকারিকেরা।

তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখের বাড়িতে গিয়ে আক্রান্ত ইডি আধিকারিকেরা। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:৫৪
Share: Save:

তৃণমূলের নেতা শেখ শাহজাহানের সন্দেশখালির বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চালাতে গিয়ে গ্রামবাসীদের একাংশের হিংসাত্মক আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে পাঁচ ইডি আধিকারিককে। শাহজাহানের ‘অনুগামী’দের ক্ষোভের হাত থেকে রেহাই পাননি ইডি আধিকারিকদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য নিয়োজিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরাও। ইডি এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী জওয়ানদের কার্যত পালিয়ে বাঁচতে হয়েছে শুক্রবার। কিন্তু কেন তৈরি হল এই নজিরবিহীন পরিস্থিতি? এর আগে বহু রাজনৈতিক নেতার ডেরায় গিয়ে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে ইডি। সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, সিংহভাগ ক্ষেত্রেই ইডির অভিযানের লক্ষ্য হয়েছে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাড়ি, অফিস। কিন্তু কোথাও তো এমন দৃশ্য দেখা যায়নি। তা হলে শুক্রবার সন্দেশখালিতে আলাদা কী ঘটেছিল? আর এই প্রশ্নের লেজ ধরেই ধিকিধিকি বাড়ছে সন্দেহ। ইডিকে দেখে কেন হঠাৎ এত উত্তেজিত হয়ে পড়লেন শাহজাহান অনুগামীরা? গুরুতর কিছু কি লুকোতে চাইছিলেন? তাই কি সরকারি কর্মীদের গায়ে হাত পড়ল? এর উত্তর মেলেনি। কিন্তু ঘটনা পরম্পরা বলছে, এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি দেখে ফেলল বাংলা। যার অভিঘাতে কেঁপে উঠেছে গোটা দেশের রাজনীতির চালচিত্র।

কী ঘটেছিল?

রেশন বণ্টন দুর্নীতির মামলাকে কেন্দ্র করে সন্দেশখালির সরবেড়িয়া গ্রামে শাহজাহানের বাড়িতে হানা দেয় ইডি। ঘড়িতে সময় তখন সকাল ৭টার আশপাশে। শাহজাহানের বাড়িতে ছিল তালা। ডাকাডাকির পরেও সাড়া না মেলায় ঘণ্টাখানেক পর বাড়ির তালা ভাঙার চেষ্টা করতে থাকেন ইডির আধিকারিকেরা। সেই সময় বেশ কিছু মানুষ সেখানে চলে আসেন। তাঁরা নিজেদের শাহজাহানের অনুগামী পরিচয় দিয়ে ইডি আধিকারিকদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জনওয়ানদের ধাক্কাও দেওয়া হয়। পিল পিল করে লোক আসতে থাকেন। কার্যত দিশাহারা হয়ে যান ইডি আধিকারিকেরা। একই রকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরাও। উন্মত্ত জনতার প্রতিক্রিয়া দেখে ইডি আধিকারিকেরা ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে যান। এর পরেও থামেনি জনতা। ইট-পাটকেল হাতে নিয়ে রাস্তা নেমে পড়েন তাঁরা। কয়েকটি রাস্তা অবরোধ করা হয়। টায়ারে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ দেখানো হয়। বেশ কয়েকটি গাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়। রোষে ভাঙাচুর হয় ইডির গাড়িও। পুরো এলাকা কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। যদিও পুরোটাই সম্পূর্ণ রকম একতরফা ছিল বলে অভিযোগ।

কেউ পালালেন অটোয়, কেউ লঞ্চে...

সরবেড়িয়া গ্রামে তৃণমূল নেতা শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি শুরু করতে যাওয়ার আগেই ব্যাপক গোলমাল। শেষ পর্যন্ত, ধাওয়া করে ইডি আধিকারিকদের এলাকাছাড়া করেন শাহজাহানের অনুগামীরা। যে গাড়ি চড়ে সন্দেশখালি গিয়েছিলেন ইডি আধিকারিকেরা সেই গাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। সেই সময়ই তিন আধিকারিক জখম হন বলে খবর। স্থানীয় সূত্রে খবর, ভাঙা গাড়িতে করেই ঘটনাস্থল থেকে ফিরে যান ইডি আধিকারিকেরা। প্রথমে তাঁরা বাসন্তী হাইওয়েতে কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করেন। তার পর সেখান থেকে অটোয় করে কয়েক জন ফিরে যান। বাকিরা লঞ্চে করে ফিরে যান স্থানীয় পুলিশের সাহায্য নিয়ে।

হাসপাতালে ইডি আধিকারিকেরা

সরবেড়িয়া গ্রামে শাহজাহানের অনুগামীদের হামলায় বিপর্যস্ত ইডির আধিকারিকেরা। অনুগামীদের মারধরে তিন জন ইডি আধিকারিক আহত হয়েছেন। কারও ফেটেছে মাথা, কেউ বা শরীরের অন্যত্র আঘাত পেয়েছেন। সকলকেই সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। ইডি সূত্রে খবর, আক্রান্ত আধিকারিক রাজকুমার রামের মাথায় চোট লেগেছে। তিনি গুয়াহাটির অফিসার। তাঁর মাথায় পাঁচ-ছ’টি সেলাই পড়েছে। স্ক্যানও করানো হয়েছে। তিনি এখন ওই হাসপাতালের এইচডিইউতে ভর্তি। বাকি দুই ইডি আধিকারিকের নাম অঙ্কুর এবং সোমনাথ দত্ত। সল্টলেকের ওই হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়েছিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস, হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। কেন্দ্রীয় এজেন্সি সূত্রে খবর, গোলমালের সময় গায়েব হয়ে গিয়েছে একটি ল্যাপটপ, ৪-৫টি মোবাইল ফোন এবং ব্যাগ। কেন ইডির ল্যাপটপ, মোবাইল সরিয়ে ফেলতে চাইবেন তৃণমূল নেতার অনুগামীরা? তা হলে কি গোটাটাই অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত? এখন এই প্রশ্নই ভাবাচ্ছে গোয়েন্দাদের।

মুখ বুজে মেনে নেবে না ইডি

সন্দেশখালির ঘটনাকে মুখ বুজে মেনে নেবে না ইডি। অন্তত শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এমনই ইঙ্গিত কেন্দ্রীয় এজেন্সির আধিকারিকদের কথায়। একই সঙ্গে জোরদার করা হয়েছে শাহজাহানের খোঁজে তল্লাশিও। অসমর্থিত সূত্রের খবর, ইডি আধিকারিকদের একটি অংশ মনে করছেন, ইতিমধ্যেই হয়তো অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছেন সন্দেশখালির তৃণমূল নেতা। শাহজাহান কি সীমান্ত পেরিয়ে বিদেশে চলে যেতে পারেন? এমনই সন্দেহ ইডি আধিকারিকদের একটি অংশের। যদিও বিষয়টি নিয়ে যতদূর যাওয়া দরকার, তত দূরই যাবে ইডি, অন্তত এমনই ইঙ্গিত আধিকারিকদের কথায়। অভিযোগ দায়েরের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছে। এই প্রেক্ষিতেই ইডির আধিকারিকদের মনে সন্দেহ আরও দৃঢ় হচ্ছে যে, আচমকা এমন মরিয়া ভাব কেন ছিল অনুগামীদের চোখেমুখে? কী লুকোতে চাওয়া হচ্ছিল? কেনই বা ইডি আধিকারিকদের মোবাইল, ল্যাপটপ গায়েব হয়ে যাবে? এর পিছনে কি তা হলে অন্য কোনও পরিকল্পনা ছিল? গুরুতর কিছু কি চোখের আড়াল করাই ছিল অনুগামীদের উদ্দেশ্য? ইডির সন্দেহ, নিশ্চয়ই সন্দেশখালিতে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা প্রমাণ রয়েছে যার ধারেকাছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের পৌঁছতে দিতে চান না ওই তৃণমূল নেতা বা তাঁর অনুগামীরা।

ফল ভুগতে হবে: রাজ্যপাল

সন্দেশখালির ঘটনায় সরাসরি রাজ্য প্রশাসনকেই দায়ী করেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। সরকারের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ‘ফল ভুগতে হবে’ বলে হুঁশিয়ারিও দিয়ে রেখেছেন তিনি। গোটা ঘটনাটিকে উদ্বেগজনক আখ্যা দিয়ে রাজ্যপাল বলেন, “সরকারের উচিত গণতন্ত্রে এই ধরনের বর্বরতাকে রোখা। কিন্তু সরকার যদি তার প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করতে না পারে, তবে দেশের সংবিধান উপযুক্ত পদক্ষেপ করবে।” সংবিধানের অবমাননা করা হলে রাজ্যপাল হিসাবে তিনি ‘উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ’ করবেন বলেও জানান বোস। রাজ্য পুলিশের ডিজি, মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিবকে রাজভবনে তলব করেন রাজ্যপাল। তাঁদের থেকে ঘটনার রিপোর্ট চান তিনি।

বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া

সন্দেশখালিতে ইডি আধিকারিকদের ‘বাধা দেওয়া’ এবং তাঁদের উপর ‘হামলা’র ঘটনায় মুখ খুলেছেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। শুক্রবার বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এক আইনজীবী। সব শুনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জানতে চান বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। বলেন, “পুলিশ কী করছিল, পুলিশ কি ঘটনাস্থলে যায়নি?” তার পরে তিনি বলেন, “রাজ্যপাল কেন ঘোষণা করছেন না, রাজ্যে সাংবিধানিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে?” এই বিষয়ে বিচারপতির সংযোজন, “তদন্তকারী সংস্থা আক্রান্ত হলে কী ভাবে তদন্ত হবে?” কেন্দ্রের ডেপুটি সলিসিটর জেনারেলের উদ্দেশে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “শুনলাম, আপনাদের লোকেদের মেরেছে। আপনারা কী করছিলেন? ওদের সঙ্গে গুলি-বন্দুক থাকে না? চালাতে পারে না?” ওই আইনজীবী তখন জানান, ইডির অফিসারদের মেরেছে। দু’জন জখম হয়েছেন। বিচারপতি তখন বলেন, “দু’জন অফিসারকে মেরেছে, ২০০ জনকে পাঠান।” সন্ধ্যায় একটি অনুষ্ঠান থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘যাঁর খোঁজে সন্দেশখালি গিয়েছিল ইডি, আমি মনে করি, রাত ১২টার মধ্যে তাঁর ইডি দফতরে হাজিরা দেওয়া উচিত।’’ পাশাপাশি, তাঁর প্রশ্ন, ‘‘রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা আছে বলে আপনাদের মনে হয়?’’

প্রত্যাশিত ভাবেই বিচারপতির এই প্রতিক্রিয়াকে ভাল ভাবে নেয়নি তৃণমূল। তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক তথা দলীয় মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস, অভিজিৎ গাঙ্গুলি— এরা সবাই এক সূত্রে বাঁধা। বিচারপতি গাঙ্গুলি, তাঁর কোন এক্তিয়ার আছে যে, চেয়ারে বসে এই ধরনের কথাবার্তাগুলি বলবেন!’’

এনআইএ তদন্ত চেয়ে সুকান্তের চিঠি শাহের মন্ত্রকে

সন্দেশখালির ঘটনায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হস্তক্ষেপ চাইছে রাজ্য বিজেপি। এনআইএ তদন্ত চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে চিঠি দিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। দলীয় সূত্রে খবর, রাজ্য বিজেপির তরফে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। সন্দেশখালিতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে সেখানে আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েনের দাবিও জানানো হয়েছে চিঠিতে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া দিয়ে রাজ্যে ‘সাংবিধানিক কাঠামো’ ভেঙে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। রাজ্য বিজেপি চিঠিতে সেই বিষয়টিও উল্লেখ করেছে।

ইডি আধিকারিকদের উপর হামলার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেই এক্স হ্যান্ডলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে কড়া পদক্ষেপের আর্জি জানিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বিষয়টি রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস এবং ইডির অধিকর্তা ও সিআরপিএফ-এর নজরেও আনেন তিনি। সন্দেশখালির ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকও।

দুষ্কৃতী ‘চিহ্নিত’ করলেন শুভেন্দু

শুক্রবারের ঘটনায় তিন জনকে ‘শনাক্ত’ করেছেন বলে দাবি করলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এই তিন জনের ছবিও নিজের এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করেন নন্দীগ্রামের বিজেপি বিধায়ক। শুভেন্দুর চিহ্নিত করা তিন জনের মধ্যে রয়েছেন তৃণমূল নেতা শেখ শাহজাহানের ভাই শেখ আলমগীর এবং শেখ সিরাজুদ্দিন। বাকি এক জনের পরিচয় জানিয়েছেন শুভেন্দুই। তাঁর নাম জিয়াউদ্দিন। নামের সঙ্গে শুভেন্দু তাঁর পরিচয় দিয়ে লেখেন, “ইনি নাম করা অস্ত্র পাচারকারী, খুনি এবং বর্তমানে সরবেড়িয়া-অগরহাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান।” বিরোধী দলনেতা দাবি করা ওই ছবিগুলির সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Enforcement Directorate TMC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE