পাথর কাটাই পেশা। নেই বিপণন। ঢাঙিকুসুমে। ছবি: দেবরাজ ঘোষ
খিদের জ্বালা সয়ে আর রাতে ঘুমোতে যেতে হয় না। বছরভর মেলে বিনে পয়সার পর্যাপ্ত রেশন।
চিড়াকুটির হাটে যেতেও আর ভাঙতে হয় না পাহাড়ি বনপথ। বছর চারেক হল পাহাড় কেটেই হয়েছে ঢালাই রাস্তা।
কিন্তু সারা বছর কাজ কই?
ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা বেলপাহাড়ির শিমূলপাল পঞ্চায়েতের ঢাঙিকুসুম হোক বা হরিনারায়ণপুর, কিংবা বেলপাহাড়ি থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েতের সাঁওতাল গ্রাম কোদোপুড়া— উপযুক্ত কাজ আর পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্যের দাবি ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্রই।
ঢাঙিকুসুমে আদিবাসী-মূলবাসী ৯৫টি পরিবারের বাস। বেশির ভাগই আদিবাসী ভূমিজ সম্প্রদায়। রয়েছে গোটা আষ্টেক শবর পরিবার। আর কিছু তফসিলি জাতিভুক্ত পরিবার। আদিবাসী ভূমিজ এবং তফলিসি পরিবারগুলির রুটিরুজি হল পাথর শিল্প। পাহাড়ের পাথর বয়ে এনে ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে কুঁদে তাঁরা তৈরি করেন থালা, বাটি, গেলাস। এক-একটা বাসন বানাতে দু’তিনদিন লাগে। কিন্তু ন্যায্য দাম পান না। লকডাউনের আগে শিলদার হাটে গিয়ে পাইকারের কাছে ১৫ টাকা, ২৫ টাকা পিস দরে পাথরের বাসন বেচে আসতেন শিল্পীরা। সেই বাসন কয়েক হাত ঘুরে শহরের দোকানে অনেক দামে বিক্রি হলেও লাভের কড়ি জঙ্গলমহলের এই গ্রামে পৌঁছয় না। এখন তো করোনা ও লকডাউনের জাঁতাকলে বাইরের হাটে বাসন বেচতে যাওয়ারও জো নেই। শিল্পীরা বলছেন, পাথরের বাসন বিপণনের স্থায়ী একটা বন্দোবস্ত হলে সুরাহা হত।
আরও পড়ুন: মতান্তরও রয়ে গেল, পাঁচটি বিষয়ে ঐকমত্য মস্কো-বৈঠকে
আরও পড়ুন: রদবদল কংগ্রেসে, রাহুলের ইচ্ছে মেনেই
চাষজমি থাকলেও সেচের অভাবে ধান ও আনাজ চাষে নিশ্চয়তা নেই। তাই যাঁরা পাথরের কাজ জানেন না, তাঁদের অবস্থা আরও সঙ্গিন। ঢাঙিকুসুমের ভাগবৎ পাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে বেলপাহাড়ি থেকে মাছ কিনে এনে সাইকেলে ফেরি করেন। তিনি বলেন, ‘‘পাথরের কাজ জানি না। চাষের কাজটুকুর পরে এলাকাবাসীর হাতে কাজের বড় অভাব।’’ গ্রামের যুবক কৃষ্ণ সিংহ গুজরাতের কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। লকডাউনে ফিরে এখন বন দফতরের প্রকল্পে মাটি কাটার কাজ করছেন। কিন্তু সব দিন কাজ মেলে না। লুলা সিংহ, ঈশ্বর সিংহের মতো গ্রামের অনেকে আবাস যোজনার বাড়িও পাননি।
একপ্রান্তে শবর পাড়ায় দুর্দশার ছবি আরও প্রকট। বৃদ্ধ মহেশ্বর শবর কানে কম শোনেন। তাই দেখিয়ে দিলেন স্ত্রী পানমণিকে। বৃদ্ধা বলেন, ‘‘এত উন্নয়ন হল, অথচ আমাদের পাড়ায় রাস্তা হল না।’’ রঞ্জিত শবর জুড়লেন, ‘‘একশো দিনের কাজে মজুরি পেতে দেরি হয়। তাই ওই কাজ আমরা করি না। জঙ্গলের কাঠ কাটাও বারণ। রেশনটুকুই ভরসা।’’ এখনও শবর পাড়ায় বাড়িতেই প্রসব হয়। চাঁদমণি শবরের ছেলে বলরাম ক’দিন আগে বাড়িতেই হয়েছে।
তৃণমূল পরিচালিত বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েতের সাঁওতাল গ্রাম কোদোপুড়ার যুবক কালীপদ হাঁসদা বললেন, ‘‘উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি। এলাকায় সারা বছর কাজের ব্যবস্থা হলে ভাল হয়।’’ ডাইনমারির সমর পাত্রের মতো অনেকেই এখন ভিন্ রাজ্যে শ্রমিকের কাজ ছেড়ে ফিরেছেন। কিন্তু এত মানুষের বছরভরের কর্মসংস্থান কোথায়!
শিমূলপাল পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় রয়েছে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ। বিরোধী আসনে বিজেপি ও তৃণমূল। পঞ্চায়েত প্রধান জলেশ্বর সিংহ মানছেন, ‘‘আগের পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তবে রাস্তার কিছু কাজ বাকি। ২০২২-এর মধ্যে সব পরিবারকে বাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে লকডাউনে পাথর শিল্পী ও খেটেখাওয়া মানুষজন খুবই সমস্যায় পড়েছেন।’’
ঝাড়গ্রামের বিজেপি সাংসদ কুনার হেমব্রমের কটাক্ষ, ‘‘কর্মহীন মানুষের মলিন মুখই জানান দেয় জঙ্গলমহল কেমন হাসছে।’’ তৃণমূলের জেলা সভাপতি দুলাল মুর্মু পাল্টা বলেন, ‘‘তৃণমূল আমলে উন্নয়নের ফলে এলাকার পুরো চেহারাই বদলে গিয়েছে। লকডাউনের পরে এলাকার মানুষ নিয়মিত একশো দিনের কাজ পাচ্ছেন।’’ বেলপাহাড়ির বিডিও বরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ‘চলতি অর্থবর্ষে (মার্চ ২০২০ থেকে) এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৮ হাজার পরিবারকে একশো দিনের প্রকল্পে গড়ে ৩৫ দিন কাজ দেওয়া গিয়েছে। ৬ লক্ষ শ্রম দিবস সৃষ্টি হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy