সরকারের ‘অবাঞ্ছিত’ হস্তক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার বিপন্ন বলে শিক্ষা শিবির যতই হইচই করুক, শাসক পক্ষ তাতে কান দেওয়া দরকার মনে করছে না।
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘরে-বাইরে, নিজের দফতরে, এমনকী বিভিন্ন আলোচনাসভাতেও বহু বার জানিয়ে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে ‘নাক গলানো’র অধিকার আছে সরকারের। এ বার তিনি বিধানসভাতেও জানিয়ে দিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে যে-টাকা দেওয়া হয়, তা আদতে জনগণের। সেই জন্য পঠনপাঠন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক এবং আর্থিক বিষয়ে সরকার হস্তক্ষেপ করতেই পারে।
কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার একটি প্রশ্নের জবাবে পার্থবাবু বুধবার বিধানসভায় বলেন, ‘‘সরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থ দেয়। এই অর্থ জনগণের। তা যদি শিক্ষার স্বার্থে খরচ করা না-হয়, তা হলে সরকার তো হস্তক্ষেপ করবেই।’’ বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বশাসিত সংস্থা। তা সত্ত্বেও সেখানে সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বরাবর সওয়াল করে এসেছেন পার্থবাবু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, কল্যাণী— সব ক্ষেত্রেই তিনি বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রশাসনিক নিয়মকানুন এবং কোন টাকা কোথায় কতটা খরচ হচ্ছে, কখন কী ভাবে খরচ হচ্ছে— সেটা দেখবেন তাঁরাই।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন সম্প্রতি বলেছিলেন, ‘‘প্রেসিডেন্সির সরকারি সাহায্য প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু আধিপত্য নয়।’’ সেই উক্তি ব্যাখ্যা করে পার্থবাবুর মন্তব্য ছিল, অমর্ত্যবাবু ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তাঁরা তো কোনও রকম আধিপত্য কায়েম করছেন না। টাকা দেওয়ার পরে তার খরচখরচার ব্যাপারে খোঁজখবর রাখাটা আধিপত্য কায়েম করার লক্ষণ বলে মনে করে না রাজ্য সরকার। পার্থবাবুর যুক্তি, টাকা দিয়ে যদি বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে বলা হয়, কোন কোন খাতে কী ভাবে কত খরচ হল, তা জানাতে হবে, তবে সেটাকে কোনও ভাবেই স্বাধিকারে হস্তক্ষেপের পর্যায়ে ফেলা যায় না।
কিন্তু শুধু তো আর্থিক বিষয়ে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক এবং আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত নানা বিষয়েও সরকার হুটহাট নাক গলাচ্ছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ছাত্র আন্দোলন ‘হোক কলরব’-এর মধ্যেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে তত্কালীন উপাচার্য অভিজিত্ চক্রবর্তীর পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেছিলেন। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারে প্রত্যক্ষ ভাবে সরকারি হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে সরব হন শিক্ষাজগতের বিশিষ্টজনেরা। তার পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অসঙ্গতি এবং তার জেরে শিক্ষকদের আন্দোলনে শিক্ষক-নিগ্রহ নিয়ে তখনকার উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে ডেকে রিপোর্ট চান পার্থবাবু। প্রেসিডেন্সির অনুষ্ঠানে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ করেছিলেন উপাচার্য় অনুরাধা লোহিয়া। সেই সময় শিক্ষাবিদেরা সমালোচনায় মুখর হলেও সমস্ত বিষয়ে নজরদারি চালানো যে সরকারের অধিকার, ফের তা জানিয়ে পার্থবাবু বলেছিলেন, ‘‘সরকার টাকা দেয়। তাই তারা নাক গলাবে।’’
শিক্ষা ক্ষেত্রের যে-সব বিশিষ্ট মানুষজন বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সরব, বুধবার বিধানসভায় তাঁদেরও কটাক্ষ করেন শিক্ষামন্ত্রী। পার্থবাবু বলেন, ‘‘শিক্ষা দফতরের হস্তক্ষেপের কথা উঠলেই তো বিদ্বজ্জনেরা স্বাধিকার ভঙ্গের কথা বলবেন! এই নিয়ে চিত্কার শুরু করবেন। কিন্তু ছড়়ি দেখিয়ে নয়, আলোচনার মাধ্যমেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা আনতে চায় সরকার।’’ একই সঙ্গে মন্ত্রী জানিয়ে দেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অসঙ্গতি নিয়ে অভিযোগের তদন্ত এখনও চলছে। এই নিয়ে সরকারের কাছে কোনও রিপোর্ট জমা পড়েনি। তাই উপাচার্য সুগত মারজিতকে ডেকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে বলেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ নিয়ে যে-সব শিক্ষাবিদ উদ্বিগ্ন, পার্থবাবুর এ দিনের কটাক্ষের পরে তারা আবার সরব হয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, টাকা দিলেই যে স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ করা চলে না, ইউজিসি-র কার্যপ্রণালীই তার প্রমাণ। ইউজিসি নানা খাতে অনেক অনুদান দেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে। কিন্তু অনুদান দেয় বলেই কথায় কথায় খবরদারি করে না। বামফ্রন্টের আমলে আলিমুদ্দিন শিক্ষা ক্ষেত্রে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য সব বিষয়ে নাক গলাত। পরিবর্তনের ডাক দিয়ে ক্ষমতায় এসেও পার্থবাবুরা সেই বাম ধারাই বজায় রেখেছেন বলে শিক্ষা শিবিরের একাংশের অভিযোগ।
পঠনপাঠনের সুস্থ পরিবেশের পক্ষে শিক্ষামন্ত্রীর এই ধরনের মন্তব্য একেবারেই স্বাস্থ্যকর নয় বলে মনে করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু। তিনি বলেন, ‘‘বারবার এই প্রসঙ্গ টেনে এনে উনি ঠিক কী প্রমাণ করতে চাইছেন, তা উনিই জানেন!’’ আর শিক্ষামন্ত্রীর রুচি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার। ‘‘টাকা দেওয়া মানেই সব বিষয়ে নজরদারি চালানো, এই কথাটি বারে বারে এ ভাবে মনে করিয়ে দেওয়াটা রুচিসম্মত নয়। এটা এক ধরনের অহমিকা। ক্ষমতার দম্ভেই এই কথা বলছেন শিক্ষামন্ত্রী,’’ অভিমত পবিত্রবাবুর।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব কোথায় কতটা, তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়। তিনি জানান, সরকার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের মাইনে দেয় ঠিকই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে আর্থিক কোনও গোলমাল হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব সরকারের নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের। নিয়ম মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটের কাগজ তো সরকারের কাছে পাঠিয়েই দেওয়া হয়। এর বেশি সরকারের কোনও অধিকার নেই। ‘‘সরকার হস্তক্ষেপ করলে তা হবে প্রথাবিরোধী কাজ,’’ বলছেন অমলবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy