Advertisement
E-Paper

শিশুদেহের খোঁজে নজর মাটির নীচেও

বিঘে খানেকের খোলা মাঠ। সেখানে একের পর এক লাগানো হল হ্যালোজেন। বেলচা, কোদাল ঘাড়ে হাজির হলেন জনা দ’শেক স্থানীয় বাসিন্দা। একটু আগেই শিশু পাচার কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত পলি দত্ত ওরফে উৎপলা ব্যাপারি এবং সত্যজিৎ সিংহকে হাজির করানো হয়েছে সেই মাঠে।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও শুভাশিস ঘটক

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৮
চলছে খোঁড়াখুড়ি। সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পিছনের মাঠে। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়।

চলছে খোঁড়াখুড়ি। সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পিছনের মাঠে। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়।

বিঘে খানেকের খোলা মাঠ। সেখানে একের পর এক লাগানো হল হ্যালোজেন। বেলচা, কোদাল ঘাড়ে হাজির হলেন জনা দ’শেক স্থানীয় বাসিন্দা। একটু আগেই শিশু পাচার কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত পলি দত্ত ওরফে উৎপলা ব্যাপারি এবং সত্যজিৎ সিংহকে হাজির করানো হয়েছে সেই মাঠে।

বসিরহাটের ‘সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ (পলির বাবার নামে তৈরি) বুধবার সিল করে গিয়েছিল সিআইডি। ওই ট্রাস্টেরই পিছনের মাঠে পলি-সত্যজিৎকে কখনও আলাদা ডেকে, কখনও এক সঙ্গে হাজির করিয়ে কিছু এলাকা চিহ্নিত করেন গোয়েন্দারা। বৃহস্পতিবার সন্ধে ৭টা নাগাদ মাঠে লাগানো হয় আলো। কোদাল-বেলচা আসে। শুরু হয় খোঁড়াখুঁড়ির তোড়জোড়। সিআইডির একটি সূত্র জানাচ্ছে, মৃত শিশু, ভ্রূণ ওই মাঠেই নাকি পুঁতে ফেলা হতো!

বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোম এবং সুজিত মেমোরিয়ালের সঙ্গে যুক্ত মাসুদা বিবি নামে এক মহিলাকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করে সিআইডি। তদন্তকারীদের দাবি, মছলন্দপুরের বাসিন্দা ওই মহিলাকে জেরা করে জানা গিয়েছে, তার মাধ্যমেই পাচারকারীরা বিভিন্ন জায়গায় পুঁতে ফেলত মৃত শিশুর দেহ-ভ্রূণ। সেই মতোই দেহ উদ্ধারের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন সিআইডি কর্তারা। ট্রাস্টের মূল নিকাশি নালা যেখানে মাঠে মিশেছে, সেই অংশও চিহ্নিত করে ঘিরে রেখেছে সিআইডি। সেখানে শিশুর কোনও দেহাংশ মেলে কিনা, তা-ও নজরে রেখেছেন গোয়েন্দারা।

কিন্তু মৃত শিশু বা ভ্রূণ এল কী ভাবে?

সিআইডির কর্তাদের একাংশের অনুমান, শিশু পাচারের পাশাপাশি বেআইনি গর্ভপাত করাত বসিরহাটের ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং বাদুড়িয়ার নার্সিংহোম। তা ছাড়া, গ্রাম থেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যে সব প্রসূতিকে আনা হতো নার্সিংহোমে, তাঁদের সন্তান অনেক সময়ে মারা যেত। পাচারের ধকল সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু হতো কোনও কোনও শিশুর। বিস্কুটের বাক্স, নোংরা-অস্বাস্থ্যকর জায়গায় লুকিয়ে রাখার জন্যও মৃত্যু হতো কিছু শিশুর। ওই সব শিশুর দেহ, ভ্রূণ পুঁতে ফেলা হতো মাটিতে। আর সুস্থ-সবল শিশুরা নানা হাত ঘুরে চলে যেত দেশ-বিদেশের নিঃসন্তান দম্পতিদের ঘরে।

শিশু পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে বুধবার রাত পর্যন্ত ধরা পড়েছে ১৩ জন। ৮ জনকে আগেই তোলা হয়েছে আদালতে। বৃহস্পতিবার ৫ জনকে আনা হয় বসিরহাট আদালতে। শিশু পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে জনরোষ এতটাই, তাদের দিকে রীতিমতো তেড়ে যায় জনতা। কোনও মতে সামাল দেয় পুলিশ।

সন্তোষকুমার সামন্ত (মহাত্মা গাঁধী রোডের শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোমের চিকিৎসক), পারমিতা চট্টোপাধ্যায় (ওই নার্সিংহোমেরই আধিকারিক) এবং প্রভা প্রামাণিককে (বেহালার সাউথভিউ নার্সিংহোমের আধিকারিক) ১২ দিনের হেফাজতে চায় সিআইডি। বিচারক তা মঞ্জুর করেছেন। বাকি দু’জনকে ১২ দিনের জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

সিআইডি-র এক আধিকারিক জানান, ঘটনার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সমাজের নানা পেশার নানা স্তরের মানুষ।

যেমন ধরা যাক বছর ষাটেকের প্রবীণ চিকিৎসক সন্তোষকুমার সামন্ত। বুধবার রাতে উত্তর ২৪ পরগনার নাগেরবাজার থেকে গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। ১৯৮১ সালে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে পাস করার পরে বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন তিনি। ১৯৯১ সালে যোগ দেন শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোমে। তদন্তকারীদের দাবি, এই চিকিৎসক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে শিশু বিক্রির প্রস্তাব রাখতেন। পাচারচক্রের অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতেন টাকার বিনিময়ে। বিভিন্ন নার্সিংহোম থেকে যে সব শিশুকে নানা কৌশলে কব্জা করত নাজমা বিবি-পলি-সত্যজিতরা, তাদের অনেকের দেখভালের দায়িত্ব ছিল সন্তোষবাবুর। শিশু বিক্রির জন্য পারমিতা-পুতুল-নাজমারা পেত ৩০-৪০ হাজার টাকা। বাকি দেড়-দু’লক্ষ টাকা নিজেই হাতাতেন সন্তোষ। নানা গোঁজামিল দিয়ে কাগজপত্র বের করে ওই শিশুকে দত্তক নেওয়া-সংক্রান্ত কাগজপত্রও তৈরি করে দিত পাচারচক্রের লোকজন।

গোটা ঘটনায় পলির ভূমিকাতেও তাজ্জব সিআইডি গোয়েন্দারা।

গোয়েন্দাদের দাবি, বাবা সুজিত দত্তের মৃত্যুর পরে পৈত্রিক জমিতে তাঁরই নামে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা খুলে আড়ালে শিশু পাচারের ব্যবসা চালাত পলি। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির বয়স মেরেকেটে বছর দেড়েক। কিন্তু তার মধ্যেই জাঁকিয়ে শিশু বিক্রির ব্যবসা ফেঁদেছিল পলি।

সিআইডি-র একটি সূত্রের দাবি, তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে ট্রাস্টের প্রেসিডেন্ট এই মহিলা। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করা বছর পঁয়ত্রিশের পলি হিন্দি-ইংরেজিতে চমৎকার কথা বলতে পারে। প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পরে সে বিয়ে করে দমদমের দুর্গানগরের বাসিন্দা অতিক্রম ওরফে রাজা ব্যাপারিকে। তাদের দুই মেয়ে। দমদমেরই বাসিন্দা সত্যজিতের সঙ্গে পরিচয় ছিল পলি-রাজাদের। পলির গাড়ি চালাত সত্যজিৎ। সেই সূত্রেই বছর দু’য়েক ধরে মালকিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে তার। পলি-সত্যজিতরা পাকাপাকি ভাবে বসিরহাটের ট্রাস্টে এসে ওঠে। সত্যজিতের স্ত্রী পূর্ণিমা অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁর স্বামী শিশু পাচারে জড়িত নন। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। যদিও সিআইডি কর্তারা জানাচ্ছেন, পলির সঙ্গে মিলে বিদেশে শিশু পাচারে জড়িত সত্যজিতও।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আড়ালে এমন বেআইনি ব্যবসার খবর ছিল না পুলিশ-প্রশাসনের কাছে? উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক অন্তরা আচার্য বলেন, ‘‘বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

(সহ প্রতিবেদন নির্মল বসু ও প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়)

Investigation underground child
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy