নরেন্দ্র মোদী বিভিন্ন সময়ে বলেন, ‘‘দুর্যোগকে সুযোগে পরিণত করতে হবে।’’ দুর্যোগের মোকাবিলাতেই ইতিবাচক কিছু ঘটানোর অবকাশ থাকে বলে তিনি মনে করেন। শুধু নিজের দল নয়, গোটা দেশকেই মোদী এই আপ্তবাক্য একাধিক বার শুনিয়েছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ‘মোক্ষম’ মুহূর্তেও বিজেপি মোদীর সেই পরামর্শ কাজে লাগাতে পারল কই!
পুজোর মুখে আকাশভাঙা বৃষ্টির জেরে কলকাতা আক্ষরিক অর্থেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সেই দুর্যোগে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকার এবং পুরসভা সমালোচনায় জর্জরিত। তা-ও মাঠে নামতে পারল না রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল। অনেকে কটাক্ষ করে বলছেন, বিজেপির ঘরেই সবচেয়ে বেশি জল ঢুকেছে! সোমবার রাতে কলকাতায় নজিরবিহীন বৃষ্টিতে বিপর্যয় পুরোপুরি ঠেকানো কিছুতেই সম্ভব ছিল না বলে শাসক তৃণমূলের দাবি। কিন্তু ভুক্তভোগীরা তা মানতে রাজি নন। তাঁরা মেয়র তথা পুর প্রশাসনের সমালোচনায় সরব। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও প্রধান বিরোধীদল বিজেপি প্রায় অদৃশ্য। বিক্ষোভ, ঘেরাও, দাবিদাওয়া নিয়ে পথে নামা নেই। দুর্গত কলকাতাবাসীর পাশে দাঁড়ানোর কোনও সংগঠিত প্রয়াসও নেই।
বিজেপি কী করেছে?
রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য মঙ্গলবার বিকেলে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন। সরকারের ‘দুর্নীতি’, ‘অসতর্কতা’ এবং ‘দূরদৃষ্টিহীনতা’কে দায়ী করেছেন। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী নিজের জেলায় বসে একটি সাংবাদিক বৈঠক করেছেন। তিনি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। বুধবার বিকালে কলকাতার প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র মীনাদেবী পুরোহিত এবং কাউন্সিলর সজল ঘোষ আরও একদফা সাংবাদিক বৈঠক করে মেয়রকে ও পুরসভাকে কাঠগড়ায় তুলেছেন।
বিজেপি কি জলে নেমেছে?
রাজ্য সভাপতি বলেছিলেন, ‘‘কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছি, দুর্গত এলাকায় ত্রাণ, শুকনো খাবার পৌঁছে দিতে। মানবিক সাহায্য নিয়ে শহরবাসীর পাশে দাঁড়াতে।’’ কিন্তু বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েকজন বিজেপি কর্মীকে ব্যক্তিগত বা স্থানীয় উদ্যোগে জলে নামতে দেখা গেলেও জেলা বিজেপি বা রাজ্য বিজেপিকে সংগঠিত প্রয়াস নিতে দেখা যায়নি। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে পাড়ায় পাড়ায় ত্রাণ বা মানবিক সাহায্য নিয়ে পৌঁছতেও দেখা যায়নি।
সমাজমাধ্যমেই ‘কেল্লা ফতে’!
পরিস্থিতি কতটা গুরুতর, তা বোঝাতে মঙ্গলবার প্রথমে জলমগ্ন মহানগরের নানা প্রান্তের ছবি ও ভিডিয়ো বিজেপি কর্মীরা সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন। তার কয়েক ঘণ্টা পর থেকে সরকারকে ‘ভেনিস’ কটাক্ষ-সহ নানা লঘু রসিকতা করেছেন। রাজ্য বিজেপির বর্তমান শীর্ষনেতারা লম্বা লম্বা পোস্ট করে সরকারের ভুল-ত্রুটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বানভাসি কলকাতায় সে সব পোস্ট ভেসে গিয়েছে কি না, তা কেউ জানেন না। যেমন জানা নেই, মঙ্গলবার দুপুর থেকে বিজেপির প্রথমসারির কোনও নেতাকে কেন জলমগ্ন এলাকাগুলিতে দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন:
প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বিরোধীদলের ভূমিকায় হতাশ। তথ্যাভিজ্ঞ একজনের কথায়, ‘‘এখনকার এই নেতারা পরিশ্রম করতে শেখেননি। দিনভর দশটা জায়গায় সশরীরে পৌঁছে লোকজনের সঙ্গে দেখা করার মধ্যে যে একটা জনসংযোগ থাকে, এঁরা তা জানেন না।’’ তাঁর উদাহরণ, ‘‘প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন বাংলা কংগ্রেস করতেন, তখন দিনের পর দিন দলের বা নিজের বক্তব্য বিবৃতি আকারে লিখে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের দফতরে নিজে নিয়ে যেতেন। সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের টেবিলে বিবৃতি জমা দিয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করার মৌখিক অনুরোধও জানিয়ে আসতেন।’’ শুধু প্রণবই নন, তৎকালীন কংগ্রেসের নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি বা সুব্রত মুখোপাধ্যায়রাও এই কায়দায় কাজ করতেন। জ্যোতি বসুর স্তরের নেতার কথা বাদ দিলে প্রথমসারির অন্য বাম নেতারাও এ ভাবেই কাজ করতেন। যেমন করেছেন নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে কারণেই তাঁরা এত দূর পৌঁছতে পেরেছেন।
রাজ্য বিজেপির প্রবীণ নেতাদের অনেকে এই বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত। উত্তর কলকাতার এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘সমাজমাধ্যম বা হোয়াট্সঅ্যাপ এসে আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে। আগের চেয়ে সহজে নিজেদের বক্তব্য সর্বত্র পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু রাজনীতি তো বক্তব্যসর্বস্ব নয়। মাঠে-ময়দানে নিরন্তর পড়ে থাকাটাও জরুরি। সেই রাজনৈতিক শিক্ষাটা মুছে যাচ্ছে।’’
বঙ্গ বিজেপির প্রবীণ নেতা রাজকমল পাঠক বলছেন, ‘‘সংগঠিত প্রয়াসের জন্য সংগঠিত টিম দরকার। শমীক সভাপতি হয়েছেন পৌনে তিন মাস হয়ে গেল। এত দিনেও তাঁকে তাঁর নিজের টিম ঘোষণা করতে দেওয়া হল না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখনও ঝুলিয়ে রেখেছেন।’’ নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রাক্তন রাজ্য সাধারণ সম্পাদকের কথায়, ‘‘দুর্যোগকে সুযোগে পরিণত করার কথা বললে অনেকে অপব্যাখ্যা করতে পারেন। কেউ বলবেন, মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করছে। কেউ বলবেন, দুর্যোগ নিয়ে রাজনীতি করছে। কিন্তু তথাকথিত রাজনীতি বা সরকারকে আক্রমণের বাইরেও অনেক কিছু করার ছিল। কিন্তু কেউ কিছু করলেন না।’’