Advertisement
E-Paper

‘বঙ্গ বিজেপির আডবাণী’ হতে চলেছেন দিলীপ? দিঘা পর্বের পর থেকে কোনও কর্মসূচিতে ডাক নেই, বানপ্রস্থের ইঙ্গিত?

সর্বভারতীয় স্তরে আডবাণীর প্রস্থান যে ভাবে ঘটানো হয়েছে, রাজ্য স্তরে দিলীপের জন্যও কি তেমনই কিছু অপেক্ষায়? সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা নেতারা প্রকাশ্যে অবশ্য তেমন কোনও মন্তব্য করছেন না।

Is Dilip Ghosh going to be Advani’s Bengal Avatar, Speculations doing rounds as course of incidents resemble

সংগঠনের সঙ্গে দিলীপের এই ‘দূরত্ব’ কি ইচ্ছা করেই তৈরি করা হচ্ছে? —ফাইল চিত্র।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২৫ ০৮:৫৮
Share
Save

দু’টি দৃশ্য। মধ্যে দু’দশকের ব্যবধান। কিন্তু দু’টিরই পটভূমি দুই সৈকতনগরী। দুই ক্ষেত্রেই ঘটনাপরম্পরার কেন্দ্রে দুই বিজেপি নেতা। দুই দৃশ্যেই সেই বিজেপি নেতারা হঠাৎ তাঁদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষের প্রশংসায়।

কুড়ি বছর আগের দৃশ্যটি যাঁকে কেন্দ্র করে, তাঁর বানপ্রস্থের পথ সে দিনের পর থেকেই প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল। এখন তিনি পরম সন্ন্যাসে। কুড়ি বছর পেরিয়ে এসে প্রায় একই রকমের ঘটনার ভরকেন্দ্রে যিনি, তিনিও কি বানপ্রস্থে যেতে চলেছেন? দলের একাংশ বলছে, লক্ষণ তেমনই। আর সেই নেতা পাল্টা প্রশ্ন করছেন, ভবিষ্যৎ কে দেখেছে?

প্রথম দৃশ্যটির স্থান করাচি, সিন্ধ, পাকিস্তান। কাল জুন মাস, ২০০৫ সাল। পাত্র লালকৃষ্ণ আডবাণী, ভারতের লোকসভায় তৎকালীন বিরোধী দলনেতা।

তার এক বছর আগেও তিনি ছিলেন ভারতের উপপ্রধানমন্ত্রী। ভারতীয় রাজনীতির কট্টর হিন্দুত্ববাদী অংশের নয়নের মণি। বিজেপিকে ২ থেকে ৮৬ এবং ৮৬ থেকে ১৮৬-তে টেনে তোলার অভিযানে তিনিই অন্যতম প্রধান কারিগর। সেই তিনি পাকিস্তান সফরে গিয়ে পৌঁছোলেন মহম্মদ আলি জিন্নার সমাধিস্থলে। পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনের পর অভিবাদন (স্যালুট) করলেন। আর জিন্নাকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এবং ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত’ আখ্যা দিলেন।

দ্বিতীয় দৃশ্যের স্থান দিঘা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। কাল ৩০ এপ্রিল, ২০২৫। পাত্র দিলীপ ঘোষ, বঙ্গ বিজেপির প্রথম সারির নেতা।

এক বছর আগেও তিনি ছিলেন মেদিনীপুরের সাংসদ। বছর দুয়েক আগে পর্যন্তও ছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি। তার বছর দেড়েক আগে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি। নির্বাচনী ফলাফলের নিরিখে তিনি যে রাজ্য বিজেপির ‘সফলতম’ সভাপতি, তা নিয়ে তাঁর প্রতিপক্ষের মনেও সন্দেহ নেই। তথ্যও তেমনই বলে। প্রতিপক্ষ তৃণমূলের দাবড়ানিতে যখন তাঁর দলের অনেক নেতা ‘সন্ত্রস্ত’, তখন তিনি গোটা রাজ্যে আস্তিন গুটিয়ে দাপিয়ে বেড়ান। কেউ শাসাতে এলে পাল্টা তেড়ে যান। লাঠি খেলা দেখান। ‘স্ট্রংম্যান’ ভাবমূর্তি বহন করেন। এ হেন দিলীপ হাজির হলেন দিঘায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে নির্মিত জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনী আয়োজনে। সেখানে সস্ত্রীক হাজির হয়ে কখনও বললেন, মুখ্যমন্ত্রীর হাত দিয়ে ‘বড় কাজ হল’। কখনও বললেন, মুখ্যমন্ত্রী ‘অক্ষয়তৃতীয়ার দিন হিন্দু জাগরণের কাজই করেছেন’।

দু’দশক আগে জিন্নাকে নিয়ে আডবাণীর মন্তব্য বিজেপির অন্দরে ঝড় তুলে দিয়েছিল। যাঁর রামরথ যাত্রার পথ ধরে বিজেপির উত্থান, তাঁর মন্তব্যই দলের আজন্ম-লালিত রাজনৈতিক লাইনের ঠিক বিপরীতে! তা-ও আবার দলের সভাপতি এবং লোকসভার বিরোধী দলনেতা পদে থাকাকালীন! কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি বিজেপি। মেনে নিতে পারেনি আরএসএস-ও। আডবাণী আর সভাপতিপদে থাকতে পারেননি। ইস্তফা দিতে হয়েছিল। ধীরে ধীরে প্রশস্ত করা হয়েছিল তাঁর বানপ্রস্থের পথ। মোদী-শাহ যুগ শুরুর পর দলের সংসদীয় বোর্ড থেকে সরিয়ে আডবাণীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আলঙ্কারিক ‘মার্গদর্শক মণ্ডলী’তে। সেই থেকে দৈনন্দিন রাজনীতির সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে বিস্মৃতির গহ্বরে চলে যেতে থাকেন আডবাণী, যা এখন সম্পূর্ণ।

সর্বভারতীয় স্তরে আডবাণীর প্রস্থান যে ভাবে ঘটানো হয়েছিল, রাজ্য স্তরে দিলীপের জন্যও কি তেমনই কিছু অপেক্ষায়? সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা নেতারা প্রকাশ্যে তেমন কোনও মন্তব্য করছেন না। সৌমিত্র খাঁ বা অর্জুন সিংহ প্রকাশ্যে দিলীপকে নিয়ে যে সব মন্তব্য করতে শুরু করেছিলেন, নেতৃত্বের নিষেধাজ্ঞায় সে সব বন্ধ করে দিয়েছেন। সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের একাংশ সমাজমাধ্যমে যে রকম বেলাগাম আক্রমণ শুরু করেছিলেন, তা-ও স্তিমিত। কিন্তু পাশাপাশিই বিজেপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দিলীপের সংযোগও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। দিলীপ নিজে থেকে দলের কর্মসূচিতে যাওয়া বন্ধ করেছেন এমন নয়। দলই নিঃশব্দে দিলীপের উপরে কোনও কর্মসূচির ভার দেওয়া আপাতত বন্ধ রেখেছে।

দিলীপ দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে যাওয়ার পরে রাজ্য বিজেপির প্রথম বড় বৈঠক ছিল ৬ মে। রাজ্য দফতরে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির জনাবিশেক গুরুত্বপূর্ণ নেতানেত্রীকে ডেকে পাঠিয়ে সে দিন প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে কথা বলেছিলেন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকরা। সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারী তো বটেই, ডাক পেয়েছিলেন দুই সংগঠন সম্পাদক, পাঁচ সাধারণ সম্পাদক, বর্তমান ও প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা। এমনকি, প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও। কিন্তু দিলীপ ডাক পাননি। পরের দিন বিধাননগরের সেক্টর ফাইভে একটি হোটেলে বিজেপির আরও বড় বৈঠক বসে। সেখানে রাজ্য পদাধিকারীরা এবং জেলা সভাপতিরা ডাক পান। প্রত্যেক জেলা থেকে আরও তিন জন করে প্রতিনিধিকে ডাকা হয়। দিলীপকে সেখানেও দেখা যায়নি। অনেকে বলছেন, দিলীপ যেহেতু রাজ্যের পদাধিকারী নন, তাই ডাকা হয়নি। কিন্তু দলের অন্য একটি অংশের যুক্তি, পদাধিকারী না হলেও দিলীপ রাজ্য কোর কমিটির সদস্য তথা প্রাক্তন সভাপতি। ওই বৈঠকে দিলীপের মতো নেতাকে ডাকায় কোনও বাধা ছিল না। শুধু বৈঠক নয়, বঙ্গে বিজেপির নানা জনসংযোগ কর্মসূচিও চলছে। প্রথম সারির রাজ্য নেতারাই রাজ্যের নানা প্রান্তে গিয়ে সে সব কর্মসূচিতে ভাষণ দিচ্ছেন। দিলীপকে আপাতত সে সব কর্মসূচিতেও যোগ দিতে বলা হচ্ছে না।

শুক্রবার কলকাতায় ‘তিরঙ্গা যাত্রা’র ডাক দিয়েছিল বিজেপি। ‘অপারেশন সিঁদুরে’ ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর পরাক্রমকে সম্মান জানাতে গোটা দেশেই বিজেপি এই কর্মসূচি পালন করছে। শুক্রবার কলেজ স্কোয়্যার থেকে শ্যামবাজার পাঁচমাথার নেতাজি-মূর্তি পর্যন্ত যে পদযাত্রার ডাক দেওয়া হয়েছিল, তাতে রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব-সহ সামনের সারির সব নেতানেত্রী থাকবেন বলে জানানো হয়েছিল। কথামতোই রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী-সহ প্রথম সারির নেতারা হাজির ছিলেন। কিন্তু দিলীপকে সেখানেও দেখা যায়নি। কোন কোন নেতানেত্রী শুক্রবারের কর্মসূচিতে থাকবেন, সে সম্পর্কে বিজেপির মিডিয়া সেল সংবাদমাধ্যমকে যে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছিল বৃহস্পতিবার, তাতেও দিলীপের নাম ছিল না।

সংগঠনের সঙ্গে দিলীপের এই ‘দূরত্ব’ কি ইচ্ছা করেই তৈরি করা হচ্ছে? নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাংসদের কথায়, ‘‘লালকৃষ্ণ আডবাণীকে যে ভাবে সম্মান রেখে ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, দিলীপ ঘোষের ক্ষেত্রেও তাই হবে। দিলীপদা পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির আডবাণী হতে চলেছেন। তাঁকেও বানপ্রস্থে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’’

ওই সাংসদ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বিজেপিতে এ ভাবে অনেককেই বানপ্রস্থে পাঠানো হয়েছে। যে সব নেতানেত্রী দলে সম্মান এবং প্রভাবে প্রথম সারিতে থেকে কাজ করেছেন, তাঁদের কারও সঙ্গে কখনও দূরত্ব তৈরি হলে সংশ্লিষ্ট নেতা বা নেত্রীকে বহিষ্কার করার পথে কখনও হাঁটে না বিজেপি। সম্মান বজায় রেখে দলের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে নীরবে সরিয়ে দিতে শুরু করে। বিজেপিতে এটাই দস্তুর। ফলে ওই বিজেপি সাংসদের মন্তব্য পুরোপুরি নস্যাৎ করার মতো নয়। তবে রাজ্য বিজেপির সংগঠন যাঁদের নিয়ন্ত্রণে, তাঁদের তরফে এখনও পর্যন্ত এমন কোনও মন্তব্য শোনা যায়নি। গোপনে বা প্রকাশ্যে। দিলীপ প্রসঙ্গে দলের রাজ্য নেতৃত্ব সম্পূর্ণ নীরব।

রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য অবশ্য প্রশ্ন এড়াচ্ছেন না। কিন্তু তাঁর উত্তর সতর্ক, ‘‘দিলীপ ঘোষ দিলীপ ঘোষের জায়গায় প্রাসঙ্গিক। আডবাণীজি আডবাণীজির জায়গায়। আডবাণীজির রাজনৈতিক উচ্চতা নিয়ে মন্তব্য করার ধৃষ্টতা কার হল জানি না।’’ এই মন্তব্যের কোনও ব্যাখ্যার মধ্যে শমীক ঢুকতে চাইছেন না।

দিলীপ নিজে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ উত্তর দিচ্ছেন। তাঁর উত্তরে কিছুটা নির্লিপ্তি, ‘‘বানপ্রস্থে এক দিন সকলকেই যেতে হয়। আমাকেও যেতে হবে। কিন্তু কবে যেতে হবে, সেটা তো আমি ঠিক করব না। অন্য কেউও ঠিক করবেন না। দেখা যাক। ভবিষ্যৎই বলে দেবে কী হতে চলেছে।’’

Dilip Ghosh LK Advani BJP Bengal Digha Jagannath Temple Mamata Banerjee

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।