Advertisement
E-Paper

‘হলং বনবাংলোতে আগুন: দুর্ঘটনা না কি দুরভিসন্ধি? তদন্ত হোক, ফিরিয়ে দেওয়া হোক আমাদের আইডেন্টিটি’

হলং ২১৭ বর্গ কিলোমিটারের জলদাপাড়া জঙ্গলের এক বিস্ময়। যে জঙ্গলের পদে পদে শুধুই রোমাঞ্চ! মূল সড়ক থেকে কাঁটাতার ঘেরা নুড়িপথ বেয়ে গাড়ি করে ঢুকলেই পরিবেশটা গা ছমছমে হয়ে যায়। সেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার এগোলেই বাঁ দিকে পড়ে বনবাংলোটি।

তন্ময় গোস্বামী

তন্ময় গোস্বামী

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৪ ২১:৩৫
হলং বনবাংলো।

হলং বনবাংলো। —ফাইল চিত্র।

আঁতকে উঠেছিলাম মঙ্গলবার রাতে! হলং বনবাংলো দাউ দাউ করে জ্বলার দৃশ্য দেখে মনটা যে কী ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল, ভাষায় বলে প্রকাশ করতে পারব না। মঙ্গলবার শুক্ল দ্বাদশীর রাত ছিল। এমনিতে চাঁদের আলোয় হলং বাংলোর সামনে বসে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া হলং নদীকে দেখা বা সামনের সল্টপিটে (নুন দেওয়া কুয়ো) জল খেতে আসা পশুপাখিদের দেখার যে কী আনন্দ, তা যাঁরা দেখেননি, তাঁরা কোনও দিনও বুঝবেন না। আমার মতো যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের পক্ষে হলং বাংলোকে ওই ভাবে জ্বলতে দেখা অতি কষ্টকর! বন দফতর বলছে, শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লেগেছে। কিন্তু কেন জানি না, খটকা লাগছে। কেন জানি না, বার বার মনে হচ্ছে যে, এর নেপথ্যে কারও দুরভিসন্ধি রয়েছে!

হলং ২১৭ বর্গ কিলোমিটারের জলদাপাড়া জঙ্গলের এক বিস্ময়। যে জঙ্গলের পদে পদে শুধুই রোমাঞ্চ! মূল সড়ক থেকে কাঁটাতার ঘেরা নুড়িপথ বেয়ে গাড়ি করে ঢুকলেই পরিবেশটা গা ছমছমে হয়ে যায়। সেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার এগোলেই বাঁ দিকে পড়ে বনবাংলোটি। বাংলোর সামনেই কিছুটা গেলেই বাঁধানো ঘাট। সামনে কুলুকুলু বয়ে চলেছে হলং নদী। নদীর ও পারে সল্টপিট বা নুনি। বিকেলের দিকে এখানেই নুন চাটতে আসে নানা জন্তু ও গাউরের দল। সন্ধ্যা ঘনাতেই এই জঙ্গলমহল চলে যায় বনচরদের দখলে। হলং পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র বনবাংলো যা একেবারে অরণ্যের মধ্যিখানে রয়েছে। জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের মূল ফটক থেকে সাত কিলোমি়টার ভিতরে। মূলত সেই কারণে দেশ-বিদেশের অরণ্যপ্রেমীদের কাছে ভীষণ প্রিয় ছিল এই বনবাংলো। শুনেছি, মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসুর পুজোর ছুটিতে প্রিয় গন্তব্য ছিল হলং। বাংলোর বারান্দায় বসে গাছপালা এবং পশুপাখি দেখে কয়েকটা দিন উত্তরবঙ্গে কাটিয়ে যেতেন। এই বাংলোয় এসে থেকেছেন কেন্দ্র ও রাজ্যের বহু উচ্চ পদস্থ কর্তারা, হাই কোর্টে জজেরা। আর আমরা যাঁরা উত্তরবঙ্গের মানুষ, তাঁদের কাছে হলং বাংলো এক রকম ‘আইডেন্টিটি’ই বটে। মঙ্গলবার ওই বাংলোটাকে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখে সত্যিই ভীষণ ভাবে ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ হচ্ছিল!

কিন্তু এখনও বোধগম্য হচ্ছে না, আগুন লাগল কী ভাবে? বর্ষায় অভয়ারাণ্য, জাতীয় উদ্যান বন্ধ থাকে। জুন মাসের ১৬ তারিখে বন্ধ হয়। খুলতে খুলতে সেই ১৫ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ জঙ্গল বন্ধ হওয়ার দু’দিন পর ১৮ তারিখ আগুন লেগেছে। যখন বাংলোয় কোনও পর্যটক থাকার কথা নয়। বনকর্তারা শুরু থেকেই শর্ট সার্কিটের কথা বলে আসছেন। কিন্তু খোঁজখবর করে জানতে পেরেছি, ওই সময় নাকি লোডশেডিং ছিল! যদি তা-ই হয়ে থাকে, তা হলে শর্ট সার্কিট হল কী করে? এই রকম একটি ঐতিহ্যবাহী বাংলোর ইলেক্ট্রিক ওয়্যারিংয়ের অবস্থা সময়ে সময়ে কেন পরীক্ষা করা হয়নি এত দিন? কী করছিলেন বনকর্তারা?

খবরে সরকারি সূত্রেরা দাবি করছে, এসির কম্প্রেসর ফেটে আগুন ভয়াবহ আকার নিয়েছিল। আমার প্রশ্ন হল, বাংলোটা পুরোপুরি কাঠের তৈরি। সেখানে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ছিল না, এটা হতে পারে না। নিশ্চয়ই ছিল। তা হলে সেই যন্ত্র ব্যবহার করে কি আগুন নেভানোর যথাযথ চেষ্টা হয়েছিল? অনেকের মনে এ-ও প্রশ্ন জেগেছে, ডুয়ার্সে গত কয়েক দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া কাঠ কী ভাবে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল? এই প্রশ্নটা আমার মনেও জেগেছে। যদিও সরকারের একাংশ পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন, নিয়মিত সংস্কারের জন্য বাংলোর কাঠের দেওয়ালে বার্নিশের আস্তরণ পুরু হয়ে ছিল। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও তা ঘৃতাহুতির কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু কেন জানি না, এতে সন্দেহ দূর হচ্ছে না। বরং এই সন্দেহের সূত্র ধরেই মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই অগ্নিকাণ্ডে কি কারও লাভ হল?

এই প্রশ্নটা ওঠা অস্বাভাবিক নয়, কারণ গত কয়েক বছরে ডুয়ার্সে আমূল পরিবর্তন এসেছে। ভোগ বিলাসে অভ্যস্ত শহুরে মানুষদের জন্য যে ভাবে ডুয়ার্সকে প্রত্যহ বদলে ফেলা হচ্ছে। চালসা ছাড়িয়ে ইতিমধ্যেই লাটাগুড়ির পথে বাতাবাড়ি এলাকায় বিরাট উপনগরী গড়ে উঠেছে। ডুয়ার্সে বিলাস-ব্যসনে ভরপুর রিসর্ট এখন অজস্র তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেখানে প্রমোদের আয়োজন অহরহ ঘটে চলেছে। এতে জঙ্গলের স্বাভাবিকতা নষ্ট হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের পর্যটনকেন্দ্রগুলির বেশির ভাগই জঙ্গলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা। সংরক্ষিত এবং জাতীয় উদ্যানকে ঘিরে থাকা রিসর্টের সংখ্যা লাটাগুড়ি, বক্সা, চিলাপাতা, জলদাপাড়া, মাদারিহাট এলাকায় কম নয়। বনের নিয়ম না মেনেই বেসরকারি লগ্নি নিয়মিত হয়ে চলেছে। জঙ্গল কেটে প্রথমে যেখানে চাষের জমি বানানো হয়েছিল, বন দফতরের উদাসীনতায় সেই জমিই পরবর্তী সময়ে চড়া দামে হোটেল মালিকেরা কিনে নিয়েছেন। সেখানে বড় বড় কংক্রিটের নির্মাণ সগড়ে তুলছেন তাঁরা। এ সব দেখেই মনে প্রশ্ন জেগেছে, হলং বাংলোর জায়গাতেও এ রকম কংক্রিটের বহুতল মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে না তো?

জলদাপাড়া, আলিপুরদুয়ার, সর্বোপরি উত্তরবঙ্গ চায়— যা ছিল, তা-ই ফিরিয়ে দেওয়া হোক। নদী-জঙ্গল-চারপাশের ভারসাম্য রাখতে ফিরিয়ে দেওয়া হোক কাঠের বাংলোটি।

(লেখক উত্তরবঙ্গের বাসিন্দা এবং পরিবেশ ও সংরক্ষণবিদ)

Hollong Bungalow
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy