Advertisement
E-Paper

টালির ঘর থেকে স্পেন, স্বপ্নের উড়ান

গলি থেকে রাজপথ। অজ গাঁয়ের টালির বাড়ি থেকে স্পেনের গবেষণাগার। পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ড সীমান্তের এক গণ্ডগ্রাম ইসলামপুরের সব্জি-বিক্রেতার ছেলে বছর তেইশের আসমাউল হকের এমন চোখ ধাঁধানো ‘সফর’-এ চমকে গিয়েছে গ্রাম।

বিমান হাজরা

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৬ ০২:৫৩
রান্নাঘরেই মা-বাবার সঙ্গে আড্ডায় আসমাউল।

রান্নাঘরেই মা-বাবার সঙ্গে আড্ডায় আসমাউল।

গলি থেকে রাজপথ।

অজ গাঁয়ের টালির বাড়ি থেকে স্পেনের গবেষণাগার।

পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ড সীমান্তের এক গণ্ডগ্রাম ইসলামপুরের সব্জি-বিক্রেতার ছেলে বছর তেইশের আসমাউল হকের এমন চোখ ধাঁধানো ‘সফর’-এ চমকে গিয়েছে গ্রাম।

সম্প্রতি দিন পনেরোর ছুটি নিয়ে স্পেন থেকে গ্রামের বাড়ি এসেছিলেন আসমাউল। দু’সপ্তাহ বাড়িতে কাটিয়ে ফিরে গিয়েছেন স্পেনের শহর তারাগনায়। সেখানে সালোকসংশ্লেষের বিশ্লেষণ এবং বিভাজন নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। আসমাউলের কথায়, “গাছের দেওয়া অক্সিজেন গ্রহণ করে প্রাণীরা বেঁচে রয়েছে। কিন্তু বন-জঙ্গল ক্রমশই কমে যাচ্ছে। কোনও দিন প্রকৃতির দেওয়া অক্সিজেনে টান পড়লে, তার বিকল্প হিসেবে কৃত্রিম উপায়ে সালোকসংশ্লেষ ঘটিয়ে অক্সিজেন তৈরির চেষ্টা করছি আমরা।’’

আসমাউলের ব্যাখ্যা, পৃথিবীতে সহজলভ্য জল তো রয়েইছে। তা থেকে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনকে পৃথক করাই যায়। কিন্তু জলের এই বিভাজন সম্ভব হলেও, তা এতটাই ব্যয়সাপেক্ষ যে নাগালের মধ্যে আনা সম্ভব হয়নি। স্পেনের ‘তারাগনা ইন্সটিটিউট ক্যাটালা ডি ইনভেস্টিগেসিও কুইমিকা (আইসিআইকিউ) রিসার্চ’ প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক অ্যান্টনি লোবটের অধীনে চলেছে সেই প্রচেষ্টা। ৯ জনের গবেষণা দলে একমাত্র ভারতীয় আসমাউলই।

ছেলে কী নিয়ে গবেষণা করছে, সফল হলে কী হবে, অত শত জানা নেই তাঁর বাবা আসরাফুল হকের। ধুলিয়ান–পাকুড় রাজ্য সড়কের পাশে সব্জি বেচেন তিনি। চার ছেলে, চার মেয়ের বিরাট সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা ছিল। এখন অবস্থা খানিক ঘুরেছে। নিজে কিংবা স্ত্রী আজমিরা, দু’জনেই নিরক্ষর। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন কোনও রকমে। ছেলেদের মধ্যে আসমাউলই বড়। বাবার সব্জির দোকানটাই হয়তো তাঁর ভবিতব্য ছিল। কিন্তু বাদ সেধেছিলেন দাদু আব্দুস শুভান।

ম্যাট্রিক পাশ দাদু ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেননি। দাদুর হাত ধরেই বাবার সব্জির দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছিল আসমাউল। তার পর পড়াশুনোয় হাতেখড়ি। আসরাফুল বলেন, “আমি তো লেখাপড়ার অত কিছু বুঝতাম না। প্রতিবেশিরা বলতেন ছেলের মেধা রয়েছে। ওকে বাইরের বড় কোনও স্কুলে ভর্তি করো। ওর মায়েরও সেটাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সংসারের হাল দেখে কখনও মুখ ফুটে বলেনি সে কথা।’’ বলে চললেন আসরাফুল, ‘‘আমিও ভাবলাম, আমি তো কখনও স্কুলের গণ্ডিতে যাইনি, সবাই যখন চাইছে তখন দু’মুঠো কম খেয়ে হলেও ছেলেকে শহরের একটা স্কুলে ভর্তি করি। করলামও তাই। আমার আর্থিক অবস্থা বুঝে স্কুলও সাধ্য মতো সাহায্য করেছে।” সেখান থেকেই ৯২ শতাংশ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক ও ৮৩ শতাংশ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মৌলানা আজাদ কলেজে রসায়নে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয় ছেলে।

আসমাউলের কথায়, “সে একটা সময় গিয়েছে। আমারও জেদ চেপে গিয়েছিল। ফুটপাথে ঘুমিয়ে থাকব, এক বেলা উপোস করে কাটাব, তবু কলকাতার কলেজ ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাব না। কষ্টের কথা বাড়িতেও জানাতে পারতাম না। এ সব শুনলে বাবা যদি মাথা গোঁজার ভিটেটাও বিক্রি করে দেন।” গায়ে কম দামি জামা, পায়ে ছেঁড়া চটি, কথায় গ্রামে টান— ছেলেটার পাশে দাঁড়িয়েছেন কেউ কেউ। অনেকে আবার দু’কথা শুনিয়েছেন, ‘গাঁইয়া’ বলে টিটকিরি দিয়েছেন। তবে স্নাতকের প্রথম বর্ষের ফল বেরোতেই আসমাউলের জীবনের মোড় ঘুরে যায় অনেকটাই। ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় হন আসমাউল। চমকে গেলেন সবাই। অজ গাঁয়ের ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাঙ্ক করেছে! এ বার ফল দেখে পাশে দাঁড়ালেন অনেকে। সরকারি বৃত্তি বরাদ্দ হল। শেষমেশ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৭৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণিতে রসায়নে স্নাতক হলেন তিনি।

বাবার দোকানে।

বাড়িতে পদে পদে দারিদ্রের ছোঁয়া। ভাবলেন, আর নয়, এ বার এ বার চাকরিতে ঢুকে পড়তে হবে। কিন্তু না। বন্ধুদের পরামর্শে মুম্বই আইআইটিতে আবেদন করলেন। পরীক্ষায় বসে শুধু সুযোগ পেলেন তা-ই নয়, মুম্বই আইআইটিতে পড়ার শেষে ক্যাম্পাসিংয়ে এক কেন্দ্রীয় সংস্থায় চাকরির সুযোগও চলে এল। বছরে ১২ লক্ষ টাকা বেতন। জীবনের প্রথম চাকরিতে লাখ টাকার বেতনটা লোভনীয় সন্দেহ নেই। কিন্তু সেখানেও বাধা দিলেন তারই খুব কাছের এক অধ্যাপক। বোঝালেন চাকরির জন্য তো পড়ে রয়েছে গোটা জীবনটাই। কিন্তু বিদেশে গিয়ে গবেষণা করার সুযোগ কখনও আসবে না। আবার শুরু হল নতুন লড়াই।

আসমাউল বলছেন, “মনে আছে অনলাইনে শ’খানেক আবেদন পাঠিয়েছিলাম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। সাড়া পেলাম জার্মানি, সুইৎজারল্যান্ড ও স্পেন থেকে। অনলাইনেই ইন্টারভিউ। হাতে এল ফেলোশিপের নিয়োগপত্র। পকেটে মাসে ভারতীয় মুদ্রায় ৮০ হাজার টাকা ভাতা নিয়ে স্পেনে পাড়ি দিলাম।’’

ছ’মাস তারাগনায় কাটিয়ে দিন পনেরোর ছুটি নিয়ে এসেছিলেন নিজের জন্মভিটেতে। ঝাড়খন্ড লাগোয়া গ্রামটার অবস্থানটাও বড় বিচিত্র। গ্রামের অর্ধেক মানুষ পশ্চিমবঙ্গের, অন্যরা ঝাড়খন্ডের। খানাখন্দে ভরা গ্রামের রাস্তার সঙ্গে স্পেনের শহরটার কোনও মিলই নেই। তাঁর কথায়, “তফাতটা আসমান-জমিন। জন্ম থেকেই যে ভাষায় কথা বলেছি, সেই গ্রাম্য ভাষার কথার টান যেন হারিয়ে গিয়েছে এখন। খাবারের ফারাকটা মারাত্মক। প্রথম মাসটা খেয়ে না খেয়ে কাটাতে হয়েছে। কোথায় বাঙালির ঝাল, মশলা দেওয়া কষা মাংস, আর কোথায় স্পেনের মাংসের ঝোলে আপেল-আঙুরের টুকরো। বাঁ দিকে পথচলায় অভ্যস্ত পায়ে স্পেনে ডান দিকে পথচলা রপ্ত করতে হয়েছে।’’

নিজের গ্রামে ঘরে ফিরে অবশ্য ফের সেই লুঙ্গি পরে আড্ডা। বাবাকে বাড়িতে খেতে পাঠিয়ে সব্জির দোকানে বসা। রান্নাঘরে মায়ের পাশে বসে রান্না শেখার চেষ্টা। স্পেনে তো নিজের হাতে রান্না করে খেতে হয়। এর মধ্যেই আবার এক ‘অঘটন’ ঘটিয়েছে ছেলে। বাবাকে সই করতে শিখিয়ে দিয়েছে। ‘‘নাহ্‌, আর ব্যাঙ্কে গিয়ে টিপ ছাপ দিতে হবে না। নিজের নামটা সই করে আসব অ্যাকাউন্টের খাতায়,’’ বললেন আসরাফুল।

বাড়ির দাওয়ায় বসে নিরক্ষর আজমিরা বিবি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন ছেলের দিকে। কত ‘বড়’ হয়ে গিয়েছে তাঁর ছোট্ট ছেলেটা। সব কিছু স্বপ্নের মতো। বললেন, “ছেলে কোথায় রয়েছে, কী করছে, কেমন আছে ভেবে বহু রাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি। এখনও পর্যন্ত কলকাতাটা কত দূর, সেটাই জানা হয়নি আমার। ছবি দেখি আর ভাবি...।’’

সত্যিই তো, মেধার কি কোনও গণ্ডি আছে! সেখানে ইসলামপুর–ভারত–স্পেন সবই যেন একাকার।

ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

Islampur research
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy