যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অবাধ্য’ পড়ুয়াদের সহবত শেখাতে যত বার তিনি মুখ খুলছেন, মুখ লুকোতে হচ্ছে বিজেপিকে! পরিস্থিতি এমন যে, কেন্দ্রে তাঁর দলের সরকারের শিক্ষামন্ত্রী স্ম়ৃতি ইরানি স্বয়ং ঘনিষ্ঠ মহলে বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছেন— কেন এ সব বলতে যাচ্ছেন উনি!
এর আগে দেশপ্রেম বিতর্কে যাদবপুরের পড়ুয়াদের ‘জুতো পেটা’ করার হুমকি দিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। এমনকী ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে ‘কলার ধরে বার করে আনা’র হুমকি দিতেও ছাড়েননি। এ বার সেখানকার ছাত্রীরা নিশানা হয়েছে রাজ্য বিজেপির এই সর্বোচ্চ নেতার। যাদবপুরের ছাত্রীদের ‘বেহায়া’, ‘ওঁচা’ এবং ‘নিম্ন স্তরের মেয়ে’ বলে অভিহিত করলেন তিনি!
কয়েক দিন আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সিনেমা দেখানো নিয়ে সেখানকার পড়ুয়াদের সঙ্গে বহিরাগত এবিভিপি কর্মীদের সংঘর্ষ ঘিরে ধুন্ধুমার হয়। বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ও ঘটনাস্থলে হাজির হন। ওই দিন বহিরাগতদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে। সে ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে দিলীপবাবু শনিবার বলেন, ‘‘যারা বিদ্যার্থী পরিষদের ছেলেদের মারছে, তারাই আবার শ্লীলতাহানির অভিযোগ করছে! যাদের এত মান-সম্মানের ভয়, তারা ও সব জায়গায় যায় কেন? এ তো বেহায়াপনা!’’ এর পর দিলীপবাবুর সংযোজন, ‘‘ওই মেয়েগুলো ওঁচা, বেহায়া ও নিম্ন স্তরের মেয়ে। ইচ্ছা করে গায়ে এসে পড়েছে!’’
রাজ্যের অন্যতম ঐতিহ্যশালী বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্পবয়সী পড়ুয়াদের উদ্দেশে দলের রাজ্য সভাপতির এমন বাছাই করা কুমন্তব্য বিড়ম্বনা বাড়িয়েছে বিজেপি নেতৃত্বের। প্রকাশ্যে মুখ না-খুললেও অনেক নেতাই দলের অন্দরে দিলীপবাবুর এমন মন্তব্য ও আচরণের তীব্র সমালোচনা করছেন। তাঁদের যুক্তি, যাদবপুরের ওই পড়ুয়াদের সঙ্গে দলের মতাদর্শগত পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করার জন্য ছাত্রীদের এ ভাবে অসম্মান কেন করা হবে? তারা তো সবাই সাধারণ পরিবারেরই মেয়ে। দলের নেতাদের একটা বড় অংশ মনে করেছেন, দিলীপবাবু একের পর এক এ ধরনের মন্তব্য করায় বিজেপি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা তৈরি হচ্ছে।
বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ ইতিমধ্যেই ‘রকের ভাষা’ ব্যবহার ও অবাঞ্ছিত আচরণের জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে রাজ্য সভাপতির নামে নালিশ ঠুকেছেন। দলীয় সূত্রের খবর, রাজ্যে দলের সহ পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহও ঘনিষ্ঠ মহলে দিলীপবাবুর মন্তব্য নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। তবে প্রকাশ্যে তিনি মুখ খোলেননি। এসএমএসে তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কোনও জবাব দেননি। আর বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘আমি যে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি না, সেটাই আমার প্রতিক্রিয়া!’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে দিলীপ ঘোষের নানা অবাঞ্ছিত মন্তব্যের বিষয়টি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী স্মৃতি ইরানির কানেও পৌঁছেছে। বিষয়টি নিয়ে তিনি যে খুবই বিরক্ত, ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি তা প্রকাশও করেছেন। ইরানি বলেছে, ‘‘কেন উনি এ সব বলতে যান!’’
দিলীপবাবুর মন্তব্যের কড়া নিন্দা করেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া এবং সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ। সূর্যবাবু ট্যুইট করেছেন, ‘‘অশালীন মন্তব্য করতেই অভ্যস্ত বিজেপির রাজ্য নেতারা। তাঁরা যে এ ধরনের কথা বলবেন, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং আরএসএস-সঙ্ঘ পরিবারের মনুবাদী-তালিবানি মানসিকতার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ এই আচরণ।’’ মানসবাবুর বক্তব্য, ‘‘দিলীপ ঘোষের ওই মন্তব্য সামগ্রিক ভাবে আমাদের রাজ্যের মহিলাদের প্রতি চরম অসম্মান। যাদবপুরের ছাত্রীরাও আমাদের পরিবারের মেয়ে। এ ধরনের মন্তব্য বিজেপির মানসিকতাকেই চিনিয়ে দেয়।’’ মানসবাবু বলেন, দিলীপবাবুর উচিত অবিলম্বে বাংলার মহিলাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁর মন্তব্য প্রত্যাহার করা। বিজেপি এ ভাবে রাজ্যের সংস্কৃতির অপমান করছে বলে অভিযোগ করেছে আরওয়াইএফ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকরাও এ দিন দিলীপবাবুর মন্তব্যের প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। যাদবপুরের এসএফআই নেত্রী গীতশ্রী সরকার বলেন, ‘‘যাঁদের মুখে দেশমাতাকে নিয়ে অত কথা, তাঁরা এক জন নারী সম্পর্কে কী ভাবে এ সব বলেন? আসলে এটাই হল ওঁদের রুচি!’’ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র সংসদ ফেটসু-র সাধারণ সম্পাদক স্বর্ণেন্দু বর্মন বলেন, ‘‘নারী সম্পর্কে এটাই বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গি। সেটাই উনি তুলে ধরেছেন। তবে যাদবপুর এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন জুটা-র সহ সভাপতি পার্থপ্রতিম বিশ্বাস বলেন, ‘‘বিজেপির মতো একটি দল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রীদের সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছে সেটা প্রত্যাশিত এবং দুর্ভাগ্যজনক।’’ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আর এক শিক্ষক সংগঠন অ্যাবুটা-র আহ্বায়ক গৌতম মাইতির কথায়, ‘‘ওঁর ভাষা ওঁর দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয়।’’