কাগ্রামের রায় পাড়ার প্রতিমা।—নিজস্ব চিত্র
জগদ্ধাত্রী পুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে কৃষ্ণনগর কিংবা চন্দননগরের নাম। তবু বাংলায় এমন কিছু স্থান আছে যেখানে জগদ্ধাত্রী পুজোই বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উৎসব। যেমন মুর্শিদাবাদের কাগ্রাম। আধুনিকতা কিংবা চাকচিক্য নয়, এখানকার পুজোর আকর্যণ সাবেক বনেদিয়ানা আর আভিজাত্য। এরই সঙ্গে মিশে আছে মেলা, নাগরদোলা, কবিগান, বাউলগান আর আবালবৃদ্ধবনিতার অনাবিল আনন্দ। জগদ্ধাত্রী এক দিনের নিষ্পাদ্য পুজো হলেও এর রেশ থেকে যায় বেশ কয়েকটা দিন।
কাগ্রাম মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার, সালার থানার অন্তর্ভুক্ত। এক কথায় জেলার প্রান্তবর্তী এক প্রাচীন বনেদি গ্রাম। রয়েছে বহু ব্রাহ্মণ, শাক্ত ও বৈষ্ণব পরিবার। মধ্য রাঢ়ের অতি প্রাচীন এই গ্রামের নামকরণ গ্রাম্যদেবী কঙ্কচণ্ডীর নামানুসারে। অতীতের কাগাঁ আজকের কাগ্রাম। পারিবারিক ও বারোয়ারি মিলিয়ে এখানে পুজোর সংখ্যা ২২টি। এ গ্রামে দুর্গাপুজো, কালীপুজো সহ অন্যান্য পুজো হলেও এ গ্রামের মুখ্য আকর্ষণ সাবেক মেজাজের জগদ্ধাত্রী পুজো।
এ গ্রামের প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম মহাশয়বাড়ির পুজো। সাবেক বাংলা রীতির প্রতিমায় আজও দেখা যায় অভিজাত্যের ছোঁয়া। শোনা যায়, পরিবারের আদিপুরুষ নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পুজো দেখে গ্রামে পুজোর প্রবর্তন করেন। পরবর্তী কালে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়। আজও পুজোর প্রধান আকর্ষণ মহিষ বলি। পুরনো প্রথা মেনে হয় কুমারী পূজাও। মহাশয়পাড়ায় বসে সাত দিন ব্যাপী মেলাও।
এখানকার প্রাচীন পুজোগুলির মধ্যে আকর্ষণীয় রায় পাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজো। আগে পারিবারিক পুজো হলেও পরে তা সর্বজনীন হয়ে ওঠে। সেই নিয়েও শোনা যায় এক কাহিনি। পুজো শুরু করেন শম্ভুনাথ রায়। এই পরিবারের স্বপনকুমার রায় বলছিলেন, রায়বাড়িতে কালীপুজো এবং দুর্গাপুজো হলেও পরবর্তী কালে শুরু হয় জগদ্ধাত্রী পুজো। তবে পুজো শুরুর পর থেকেই প্রতিবছর কোনও না কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। এমনটা বেশ কয়েক বছর হতে থাকায় পুজোর উদ্যোক্তারা নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজের কাছে ব্যাপারটা জানান। সব শুনে তাঁরা বিধান দেন একই বাড়িতে তিন শক্তির পুজো করা শাস্ত্রসম্মত নয়। তাঁরাই বিধান দেন পাড়ার যে কোনও পড়শির কাছে চাঁদা আদায় করে পুজোটি সর্বজনীন করে দিতে। এ ভাবেই পুজোটি সর্বজনীন হয়ে ওঠে। এখানে পুজোয় সঙ্কল্প হয় মহিলাদের নামে। প্রতি বছর আলোকসজ্জায় থাকে অভিনবত্ব। পুজোর দিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে পুজোর শুরু হয়। পুজোয় থাকে চাল ও চিনির নৈবেদ্য, নানা ধরনের মিষ্টি। পুজোর ভাগেও থাকে বৈচিত্র। যেমন সপ্তমীতে থাকে ভাত, শাক, ভাজা মাছ, তরকারি চাটনি। অষ্টমীতে খিচুড়ি, পোলাও, ভাজা, তরকারি। আর নবমীতে থাকে লুচি, সুজি ইত্যাদি। অতীতে পশুবলি হলেও এখন চালকুমড়ো বলি হয়।
১৩৮ বছরের পুরনো ব্রহ্মপদ রায়চৌধুরীর বাড়ি পুজোটি সকলের অংশগ্রহণে সর্বজনীন রূপ পায়। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে জমিদার সুরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর মা রাধারানি দেবীর সময় থেকে পুজো হয়ে আসছে। পরিবারের উত্তরসূরিরা বর্তমানে এই পুজো করছেন। তেমনই ১২০ বছরের পুরনো ‘সাত আনার পুজো’ শুরু করেন বসন্তকুমারী দেবী। বর্তমানে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের উত্তরসূরিরা এই পুজো করে চলেছেন। ১৯৭২ সালে শুরু হওয়া মধ্য-পশ্চিমপাড়া বারোয়ারির আকর্ষণ বাউল গান এবং অর্কেস্ট্রা। পশ্চিমপাড়া সর্বজনীনের পুজোটি এ বার ১১৫ বছরে পড়ল। আগে পারিবারিক পুজো হলেও পরে এটি সর্বজনীন রূপ পায়। এখানকার আলোকসজ্জা, বাউলগান, বিচিত্রানুষ্ঠান বরাবরই আকর্ষণীয়। এক কালে রক্ষাকর রায়চৌধুরীর বাড়ির প্রতিমার বিসর্জনের শোভাযাত্রা ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়। তখন অবশ্য বারোয়ারি পুজোর এত রমরমা ছিল না। ১৩২১ সালে তিনিই পুজো শুরু করেন।
চার দশক ধরে হয়ে আসছে পালবাড়ির পুজো। আগে কলকাতার কুমোরটুলি থেকে এখানে প্রতিমা আনা হতো। এখানে কুমারী পুজা ও নারায়ণ সেবা উল্লেখ্য। একাদশীর দিন প্রতিমা বিসর্জন ও আতসবাজির প্রদর্শন উল্লেখ্য। এ ছাড়াও মিস্ত্রিবাড়ি, বন্দ্যোপাধ্যায়বাড়ি, দে-বাড়িতে পুজো হয়।
তবে শুধু সাড়ন্বরে পুজো নয়। কাগ্রামের জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রাও সমান আকর্ষণীয়। এক একটি প্রতিমার শোভাযাত্রা হয় দীর্ঘ বিস্তৃত। সঙ্গে থাকে আলোকসজ্জা এবং নানা ধরনের বাজনা। যেমন ব্যান্ড তাসা ইত্যাদি। বিসর্জন উপলক্ষে মেলে প্রশাসনের বিশেষ সহযোগিতা। প্রতিটি পাড়ার প্রতিমার সঙ্গে থাকে পুলিশ পোস্টিং।
সময়ের সঙ্গে হারিয়েছে অতীতের সেই কারবাইড ল্যাম্পের আলো। তার পরিবর্তে এসেছে এলইডি আলো। তবু পুজোর আচার অনুষ্ঠানে কিংবা প্রতিমায় আজও অটুট সাবেক বনেদিয়ানার ছোঁয়া। বদলায়নি প্রতিমার রূপও। সেই ডাকের সাজের টানা চোখের প্রতিমা। আগে বাহকদের কাঁধে চেপে প্রতিমা বিসর্জনে গেলেও এখন ট্রলিতে কিংবা ভ্যানে প্রতিমা বিসর্জনে যায়। যে সব পুজোগুলি শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে প্রশাসনের তরফে পুজো কমিটিকে প্রতিমা তোলার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে। সেই অনুযায়ী হয় বিসর্জন। মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে এই সব প্রতিমা সারা রাত গ্রাম প্রদক্ষিণ করে পরদিন সকাল ৯টা নাগাদ মণ্ডপে ফেরে। তার পরে শুরু হয় বিসর্জন পর্ব।
আরও পড়ুন: কৃষ্ণচন্দ্রের স্বপ্নে দেখা দেবীই পূজিত হন জগদ্ধাত্রী রূপে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy