Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

তাইল্যান্ডের উদ্ধারেও যেতে চেয়েছিলেন ‘গিল সাব’

বৃহস্পতিবার সকালে ফোনে সেই ‘গিল সাব’ বললেন, ‘‘বিশ্বের এক্সপার্টরা সেরা প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন তাইল্যান্ডে। ২৯ বছর আগে আমরা এই কাজটাই করেছিলাম দেশের প্রযুক্তিতে ভরসা করেই।’’

যশবন্ত সিংহ গিল

যশবন্ত সিংহ গিল

সুব্রত বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৮ ০৪:৪৪
Share: Save:

তাইল্যান্ডের গুহায় ১২ কিশোরের আটকে পড়ার খবর টিভিতে দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে পড়ছিলেন অমৃতসরের ৭৮ বছরের বৃদ্ধ। ছেলেকে ডেকে বার বার বলছিলেন, ‘‘ওদের এমব্যাসিতে ই-মেল করে আমার পরিচয় দিয়ে জানাও, দরকার হলে যেন আমাকে ডেকে পাঠায়।’’

ছেলে অবশ্য বাবার বয়সের কথা ভেবে ই-মেল করেননি। কিন্তু যাঁরা যশবন্ত সিংহ গিলকে চেনেন, তাঁরা জানেন, অন্যের জান বাঁচানোর জন্য নিষেধ শোনার বান্দা নন তিনি। ১৯৮৯ সালের ১৩ নভেম্বর রানিগঞ্জের মহাবীর কোলিয়ারিতে ৩৮০ ফুট নীচে আটকে প়ড়া ৬৫ জনকে তোলার জন্য লোহার ‘ক্যাপসুল’-এ নেমে গিয়েছিলেন তিনি। সকলকে উদ্ধার করার পর ‘ক্যাপসুলে’ উঠেছিলেন সবার শেষে। তাঁর বীরত্বের কাহিনি রয়েছে বহু রাজ্যের পাঠ্যবইয়ে। তাঁকে নিয়ে বলিউডে হচ্ছে ফিল্ম। বৃহস্পতিবার সকালে ফোনে সেই ‘গিল সাব’ বললেন, ‘‘বিশ্বের এক্সপার্টরা সেরা প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন তাইল্যান্ডে। ২৯ বছর আগে আমরা এই কাজটাই করেছিলাম দেশের প্রযুক্তিতে ভরসা করেই।’’

কী সেই প্রযুক্তি? দিনরাত এক করে তৈরি হয়েছিল ‘ক্যাপসুল’-এর মতো দেখতে লোহার খাঁচা। যাতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ। কুয়োর মতো একটি ‘বোরহোল’ তৈরি করে দড়ি দিয়ে বেঁধে তা নামিয়ে দেওয়া হয় খনির ভিতরে। কোলিয়ারির দেওয়াল ভেঙে ঢোকা জলে তখন ভাসছে গোটা খনি। পাম্পে জল বার করা যাচ্ছে না। খনির মুখ এবং লিফটের দিক ভেসে গিয়েছে জলের তোড়ে। ভেসে গিয়েছেন ৬ জন শ্রমিক। বাকি ৬৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন খনির মধ্যে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায়। প্রায় তিন দিন ধরে অন্ধকারে, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা জলে দাঁড়িয়ে উদ্ধারের প্রতীক্ষায় রয়েছেন তাঁরা। তাঁদের বুঝিয়ে সুশৃঙ্খল ভাবে উপরে তুলে আনার জন্য দরকার ছিল একজন জবরদস্ত লোকের। কিন্তু চার দিকের নরম মাটি ধসে মাঝপথে যদি কোনও ভাবে আটকে যায় ‘ক্যাপসুল’! কে এই ঝুঁকি নেবে? এগিয়ে এসেছিলেন বছর পঞ্চাশের যশবন্ত সিংহ গিল, কোল ইন্ডিয়ার তৎকালীন পদস্থ ইঞ্জিনিয়ার।

কুনস্তরিয়ায় সংরক্ষিত মহাবীর খনিতে উদ্ধারকাজের সেই ক্যাপসুল। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ।

এই প্রতিবেদক সাক্ষী, ‘গিলসাব’কে ক্যাপসুলে নামতে সবাই বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি শোনেননি। ১৫ নভেম্বর রাত আড়াইটে নাগাদ নিজেই সটান উঠে গিয়ে ভিতর থেকে দরজা টেনে বন্ধ করে দিয়েছিলেন গিল। তারপর ধীরে ধীরে নামিয়ে দেওয়া হয় ‘ক্যাপসুল’। গিল বলেন, ‘‘ক্যাপসুল মাটিতে ঠেকতেই টুপির আলোয় (ক্যাপল্যাম্প) দেখলাম, ঘন অন্ধকারে এক শ্রমিক এগিয়ে এসেছেন। তাঁকেই ধরে আগে তুলে দিলাম ক্যাপসুলে। দড়ি নেড়ে সিগন্যাল দিতেই উঠে গেল খাঁচা। হাত দিয়ে টেনে তোলা হচ্ছিল খাঁচাটা। ওকে নামিয়ে খাঁচা আবার আসতে লাগবে কুড়ি মিনিট। এই সময়েই শুরু করলাম কাজ।’’

কোলিয়ারির চারদিকের দেওয়াল থেকে, ছাদ থেকে তখন জল নামছে। জল-কাদায় দাঁড়িয়ে আরও ৬৪ জন। ব্যাটারির ‘চার্জ’ বাঁচানোর জন্য শুধু এক জন জ্বেলে রেখেছেন ক্যাপল্যাম্প। গিল বলেন, ‘‘সব চেয়ে কঠিন কাজ, এই সময়ে সবাইকে মনোবল জোগানো। ওঁদের বললাম, অসুস্থ ও জখমেরা আগে যাবেন। সব শেষে আমি উঠব। সেই মতো একে একে ওঠা শুরু হল।’’ পরে ক্যাপসুলে লাগানো হল মোটর। কাজ হল অনেক দ্রুত। গিল তখন ঠাট্টা-মস্করা করে চাঙ্গা রাখছেন সবাইকে।

বৃদ্ধ বলেন, ‘‘খুব কঠিন কাজ ছিল। কোনও শত্রুর সঙ্গে নয়, লড়ছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে। কিন্তু আমরা পেরেছিলাম। সম্পূর্ণ নিজেদের জোরে, নিজেদের শক্তিতেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jaswant Singh GIll Thailand Rescue mission
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE