Advertisement
০৬ মে ২০২৪
Recruitment Scam

অনুব্রতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, শিক্ষাকর্তাদের সান্নিধ্য! জীবনকৃষ্ণের উত্থান হয়েছিল রকেট গতিতে

বিধায়কের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই একই সময়ে রাজ্য শিক্ষা দফতরের একাধিক কর্তার সঙ্গেও জীবনকৃষ্ণের যোগাযোগ তৈরি হয়। তাঁদের সুপারিশেই ২০১৮ সালে তাঁর জেলার রাজনীতিতে পা দেওয়া।

অনুব্রত মণ্ডল এবং জীবনকৃষ্ণ সাহা। নিজস্ব চিত্র।

অনুব্রত মণ্ডল এবং জীবনকৃষ্ণ সাহা। নিজস্ব চিত্র।

প্রণয় ঘোষ
বড়ঞা শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২৩ ২১:১৪
Share: Save:

ঘটনা ১: তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ ‘এড়াতে’ পাঁচিল টপকে পালানোর চেষ্টা করছেন শাসকদলের বিধায়ক! কারণ, তাঁর বাড়ির অদূরে জঙ্গলে বস্তা বস্তা ‘নথি’র হদিস মিলেছে!

ঘটনা ২: গোয়েন্দাদের হাতে যাতে না চলে যায়, সে জন্য মোবাইল ফোন, পেনড্রাইভ এবং হার্ডডিস্ক পুকুরে ছুড়ে ফেলা হল। সেগুলি উদ্ধার করতে গিয়ে ছেঁচে তোলা হচ্ছে পুকুরের জল!

নতুন বছর শুরুর দিনে মুর্শিদাবাদের বড়ঞার বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহার বাড়িতে সিবিআইয়ের তল্লাশি অভিযান ঘিরে ঘটনার এমন ঘনঘটায় বিস্মিত সকলেই। ওই সব নথি ও গেজেটস ‘নিয়োগ দুর্নীতি’ সংক্রান্ত বলেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার গোয়েন্দাদের দাবি।

শুক্রবার বেলা ১২টা নাগাদ জীবনকৃষ্ণের বাড়ি ‘সাতকড়ি স্মৃতি’তে যে তল্লাশি অভিযান শুরু হয়েছিল, তার পর ৩২ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। তদন্তকারীদের সূত্রে প্রকাশ্যে এসেছে একের পর এক তথ্য। বিধায়কের নাম ‘চাকরি দুর্নীতি’তে জড়িয়ে যাওয়ার পর এ বার তাঁর সঙ্গে অনুব্রত মণ্ডলের ‘ঘনিষ্ঠতা’র কথাও জানা গেল। অনুব্রত এখন গরু পাচার মামলায় গ্রেফতার হয়ে দিল্লির তিহাড় জেলে। শাসক দলের একাংশের মত, বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রতের সান্নিধ্যে আসার পর থেকেই উল্কাগতিতে উত্থান হয় জীবনকৃষ্ণের। পরে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সহায়কের সুপারিশে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ।

জীবনকৃষ্ণের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ব্যবসায়ী পরিবারে। আন্দির স্কুল থেকে পাশ করে ভর্তি হন বীরভূমের সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজে। এর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে ২০০৪-’০৫ সাল নাগাদ বড়ঞার বেলডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহ-শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবনে প্রবেশ। রাজ্যে পালাবদলের পর ২০১২-’১৩ সাল নাগাদ বীরভূমেরই নানুরের দেবগ্রাম হাই স্কুলে সহ-শিক্ষক হিসাবে যোগ দিতে আবার বীরভূমে আসেন জীবনকৃষ্ণ। সেখানেই তাঁর সঙ্গে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত এবং অনুব্রতের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে প্রবেশ। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাঁর প্রভাব। পাল্লা দিয়ে বাড়ে সম্পত্তির পরিমাণও। পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, বোলপুরে ফ্ল্যাট, সাঁইথিয়ায় চালকল, আলুর দু’টি স্টোরেজ— এই সব কিছুই হয়েছে কয়েক বছরে। সাঁইথিয়া মৌজা এলাকায় তাঁর পাঁচ কোটি টাকার জমি রয়েছে বলেও দাবি। এই সবের মধ্যে জাল শংসাপত্র তৈরির অভিযোগও উঠেছিল জীবনকৃষ্ণের বিরুদ্ধে।

বিধায়কের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই একই সময়ে রাজ্য শিক্ষা দফতরের একাধিক কর্তা ও মন্ত্রীর আপ্তসহায়কের সঙ্গেও জীবনকৃষ্ণের যোগাযোগ তৈরি হয়। তাঁদের সুপারিশেই ২০১৮ সালে তাঁর জেলার রাজনীতিতে পা দেওয়া। এর পর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম বার তৃণমূলের টিকিটে লড়ে বিধায়ক হন জীবনকৃষ্ণ। খুবই অল্প ব্যবধানে হারিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থীকে। বিরোধীদের অভিযোগ, শুধু নিজের উন্নতিই নয়, পরিবারের লোকেদেরও চাকরি পাইয়ে দিয়েছিলেন জীবনকৃষ্ণ। শিক্ষ দফতরের কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রেই স্ত্রী টগরী সাহা বাড়ির সামনে আন্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি পান! শুধু তা-ই নয়, ২০২২ সালে শ্যালক নিতাই সাহার প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে চাকরি জীবনকৃষ্ণের সুপারিশেই হয় বলে অনেকের অভিযোগ।

জীবনকৃষ্ণের বিরুদ্ধে ‘চাকরি দুর্নীতি’র অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। সিবিআই সূত্রে খবর, ২০১৬ সালে শিক্ষকতার চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগে তাঁর বাড়িতে হানা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। দলের ব্লক সভাপতির পদ পাইয়ে দেওয়ার নাম করে প্রাক্তন যুব সভাপতির কাছ থেকে কয়েক লক্ষ টাকা চাওয়ারও অভিযোগও উঠেছিল জীবনকৃষ্ণের বিরুদ্ধে। সেই সংক্রান্ত একটি অডিয়ো ক্লিপ (সেটির সত্যতা আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি)-ও প্রকাশ্যে এসেছিল। সম্প্রতি বড়ঞার ভড়ঞা গ্রামের কৌশিক ঘোষ নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হতেই জীবনকৃষ্ণকে নিয়ে নতুন করে চর্চা শুরু হয়। তার পরেই বিধায়কের বাড়িতে এই সিবিআই তল্লাশি অভিযান।

পঞ্চায়েত ভোটের আগে বিধায়কের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান নিয়ে জেলায় স্বাভাবিক ভাবেই বেকায়দায় পড়েছে শাসকদল। কটাক্ষ করে বিজেপি বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষ বলেন, ‘‘চুরি করতেই সবাই তৃণমূলে যোগ দিয়েছে। পার্থ, অনুব্রতের সঙ্গে অবিলম্বে এঁদের ধরা উচিত।’’ জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ। মুর্শিদাবাদ জেলা তৃণমূলের সভানেত্রী শাওনি সিংহ রায় শুধু বলেন, ‘‘আ‌ইন আইনের পথে চলবে। তবেন কেন্দ্রীয় সংস্থার অভিসন্ধি আমরা প্রত্যেকেই জানি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Recruitment Scam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE