মাওবাদী নারীবাহিনীর কথা এত দিন জানা ছিল। এ বার ধরা পড়ল পশ্চিমবঙ্গে একটি জেহাদি প্রমীলা বাহিনীর অস্তিত্ব। সৌজন্য, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ। তদন্তকারীদের এ-ও ধারণা, ঘটনায় নিহত শাকিল আহমেদের স্ত্রী রাজিয়া বিবি এবং জখম আব্দুল হাকিমের স্ত্রী আলিমা বিবি দু’জনেই ওই নারী বাহিনীর সদস্য। ওই দু’জন গ্রেফতার হলেও বাহিনীর বাকিরা এখনও অধরা।
বর্ধমান-বিস্ফোরণের তদন্তের সূত্রেই এনআইএ জানতে পেরেছে, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, নদিয়া, বর্ধমান রাজ্যের এই চার জেলা ও বাংলাদেশ থেকে আসা ২০-২৫ জন তরুণীকে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে জেহাদি জঙ্গিদের ওই নারীবাহিনী। সদস্যদের বয়স আঠারো থেকে পঁচিশ। প্রত্যেকে কট্টর ধর্মীয় ভাবাবেগে চালিত, জাগতিক অন্য সব বিষয় তাদের কাছে তুচ্ছ। নিয়মিত ব্যায়ামে প্রত্যেকে সুস্থ-সবল, নাইন এমএম পিস্তল চালাতে দক্ষ। কয়েক জন আবার আইইডি বানাতেও দড়। বস্তুত যে কোনও সময়ে বড়সড় আঘাত হানার জন্য তারা পুরোদস্তুর তৈরি বলে গোয়েন্দারা মনে করছেন।
ফলে দেওয়ালির মুখে পুলিশ যথেষ্ট চিন্তায়। কিন্তু কাদের তত্ত্বাবধানে মেয়েদের নিয়ে এমন একটা ঘাতকদল গড়ে তুলল জেহাদিরা?
এনআইএ-র দাবি: বাহিনী গঠন ও যাবতীয় প্রশিক্ষণের প্রধান দায়িত্বে ছিল আয়েষা বিবি, যে কিনা বর্ধমানের মঙ্গলকোটের কৃষ্ণবাটী গ্রামের বাসিন্দা মৌলানা ইউসুফ শেখের স্ত্রী। এনআইএ-র মতে, খাগড়াগড়-কাণ্ড যে আন্তর্জাতিক জঙ্গি-জালকে প্রকাশ্যে এনেছে, পশ্চিমবঙ্গে তার চাঁই হল ইউসুফ। জেহাদিদের অন্যতম আঁতুড় হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত শিমুলিয়া মাদ্রাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ আপাতত ফেরার। আয়েষাও পালিয়েছে। এনআইএ-র দাবি: ইউসুফ, আয়েষা দু’জনেই জমিয়ত-উল-মুজাহিদিনের সদস্য। শিমুলিয়া ও লালগোলার মকিমনগর মাদ্রাসায় পড়তে আসা মেয়েদের থেকে পছন্দসইদের বেছে নিয়েছিল আয়েষা। বছর তিনেক আগে তারই তত্ত্বাবধানে মেয়েগুলির মগজধোলাই ও অস্ত্র তালিম শুরু হয়। শিমুলিয়া ও মকিমনগর মাদ্রাসাই ছিল প্রশিক্ষণস্থল। তালিম দিত কারা?
এক তদন্তকারী বলেন, “আয়েষা তো ছিলই। আরও কিছু মহিলা প্রশিক্ষকের খবর আমরা পেয়েছি। বাংলাদেশ থেকেও কেউ কেউ এসেছিল। তারা জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর সদস্য।”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বিএনপি জমানার শেষাশেষি জেএমবি এমন এক প্রমীলা বাহিনী তৈরি করেছিল। তাতে কিছু আত্মঘাতী জঙ্গিও ছিল। এনআইএ-র দাবি, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সূত্রে ভারতের মাটিতে জমিয়ত-উল-মুজাহিদিনের সঙ্গে জেএমবি-র আঁতাত সামনে এসেছে এবং পশ্চিমবঙ্গে নারী জঙ্গি বাহিনীর পত্তন হয়েছে জেএমবি-রই পরামর্শে। আত্মঘাতী মহিলা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের ভিডিও টেপ-ও মিলেছে খাগড়াগড়ে।
কেন্দ্রীয় আইবি-র ধারণা, জেএমবি ও জমিয়ত-উল-মুজাহিদিনকে মেলাতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে ওসামা বিন লাদেনের আল কায়দা। উল্লেখ্য, আল কায়দা-র বর্তমান প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির লেখা সাত পাতার যে চিঠিটি ২০০৯-এ ফাঁস হয়, তাতে জেহাদে মহিলাদের সামিল হওয়ার আহ্বান রয়েছে। আফগানিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত হানার লক্ষ্যে আল কায়দা-ই গড়েছিল প্রমীলা জঙ্গি বাহিনী ‘বোরখা ব্রিগেড।’ আত্মঘাতী নারী জঙ্গির মারণ হানার দৃষ্টান্তও রয়েছে ভারতে। এলটিটিই-র এমন এক হামলায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীকে প্রাণ দিতে হয়।
শিমুলিয়া-লালগোলায় মেয়ে জঙ্গিদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো? এনআইএ-র দাবি: ছুটির মরসুমে জেহাদি শিক্ষার পাঠ চলতো, সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র চালনার তালিম। নাইন এমএম পিস্তল ‘কক’ করা, গুলি বেরোনোর সময়ে ঝটকা সত্ত্বেও কী ভাবে নিশানা নির্ভুল রাখা যাবে এই সমস্ত শেখানো হতো, ছোট ছোট ‘কোর্স’-এর মাধ্যমে। প্রতিটি ‘শিক্ষাক্রমের’ মেয়াদ ছিল তিন দিন। ধর্মীয় আচার-বিধিও ছিল তার অঙ্গ।
রাজিয়া, আলিমা ছাড়াও জিন্নাতুর বিবি, জরিনা বিবি, রুম্পা খাতুন ও খালেদা বিবি বীরভূমের এই চার তরুণী শিমুলিয়া ও মকিমনগর মাদ্রাসায় জঙ্গি তালিম নিয়েছিল বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ। চার জনই অবশ্য ফেরার। তাদের খোঁজ করতে রাজ্যে আরও মহিলা অফিসার ও কনস্টেবল আনছে এনআইএ। “মাওবাদী নেত্রী জাগরী বাস্কে, সুচিত্রা মাহাতো, শোভা মান্ডিরা দু’-তিন বছর আগে মূলস্রোতে ফিরেছে ঠিকই। কিন্তু এখন ঘুম কেড়েছে আয়েষারা।” মন্তব্য এক আইবি-কর্তার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy