Advertisement
১১ মে ২০২৪
Barrackpore Shootout

জেদি আর প্রতিবাদী ছিল, ডাকাতদের বাধা দিতে গিয়ে প্রাণটাই দিয়ে দিল! শোকে বিমূঢ় চারমূর্তির বাকি তিন

ব্যারাকপুরে নিজেদের গয়নার দোকানে ডাকাতদের বাধা দিতে গিয়ে নিহত হয়েছেন নীলাদ্রি সিংহ। তাঁর বন্ধুরা শোকে বিমূঢ়। শুধু বন্ধু হারানো নয়, আরও অনেক কিছুই শেষ হয়ে গেল তাঁদের।

friends

চারমূর্তি। বাঁ দিক থেকে শুভ্র মুখোপাধ্যায়, শুভদীপ ঘটক, সায়ন মিত্র, নীলাদ্রি সিংহ। — নিজস্ব চিত্র।

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২৩ ১৯:১৮
Share: Save:

গুনগুন করে সব সময়ে গান গাইতেন। লেখাপড়া শেষ করে বাবার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন। তবে সেটা শুধু অর্থোপার্জনের জন্য নয়। ছোট থেকেই ছবি আঁকা শিখতেন। পরে সেটা নেশার মতো হয়ে যায়। নিজেদের দোকানের সব গয়নার নকশা নিজেই আঁকতেন তিনি। বুধবার সন্ধ্যায় ব্যারাকপুরে নিজেদের সেই দোকানেই ডাকাতদের বাধা দিতে গিয়ে গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন নীলাদ্রি সিংহ। তিনি নেই, এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না তাঁর প্রাণের বন্ধুরা। বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁদেরই একজন, শুভ্র মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘ওর বাড়িতে গেলে দেখবেন, দেওয়াল জুড়ে শুধু ছবি। সব নীলুর আঁকা। বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা লতাপাতার কাজ রয়েছে। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ভাবতেই পারছি না, ও আর ছবি আঁকবে না! গুনগুন করে গান গাইবে না!’’

ওঁরা ছিলেন ‘চারমূর্তি’। শুভ্র ছাড়া বাকি দু’জন হলেন শুভদীপ ঘটক এবং সায়ন মিত্র। সায়নের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। শুভদীপ কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। তিনিই ফোন ধরিয়ে দিলেন শুভ্রকে।

Niladri Singha

জেদি হলেও নীলাদ্রির ব্যবহার ছিল শান্ত। — নিজস্ব চিত্র।

চার বন্ধু একসঙ্গে ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে লেখাপড়া করেছেন। ২০১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তার পরে কারও কলেজ বদলে যায়। আবার কেউ একই কলেজে থাকলেও বিষয় অন্য। নীলাদ্রি ভূগোল অনার্স নিয়ে পড়েছেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। কিন্তু চার জনের বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি। যেমন ছেদ পড়েনি নীলাদ্রির নিরন্তর ছবি এঁকে যাওয়ায় বা গয়নার নকশা তৈরি করে যাওয়ায়।

নীলাদ্রি যে প্রেমে পড়েছেন, সকলের আগে বাকি তিন মূর্তিই জেনেছিলেন। ব্যারাকপুরেরই বড়পোল এলাকার বাসিন্দা সেই প্রেমিকা ঐন্দ্রিলা মান্নার সঙ্গে সামাজিক ভাবে বিয়ে হয়েছিল নীলাদ্রির। গত ৮ ডিসেম্বর। প্রথম জামাইষষ্ঠীর আগেই ছ’মাসের দাম্পত্য শেষ! এখনও বন্ধুপত্নী ঐন্দ্রিলার মুখোমুখি হওয়ার সাহস করে উঠতে পারেননি তিন বন্ধু।

শুভ্র জানিয়েছেন, জেদি ছিলেন নীলাদ্রি। বলছিলেন, ‘‘যে কোনও বিষয়েই ওর একটা প্রতিবাদী সত্তাও ছিল। তা বলে যে ও খুব চোটপাট করত, তা নয়। খুব নরম স্বভাবের ছিল। আস্তে আস্তে কথা বলত। শান্তশিষ্ট ছিল। একেবারে শিল্পীদের মতোই। কিন্তু বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় যে কোনও খারাপ বিষয়ের বিরুদ্ধে ও মতামত দিত।’’

সেই প্রতিবাদী চরিত্রই কি অকালে কেড়ে নিল নীলাদ্রিকে? শুভ্র বলেন, ‘‘শুনেছি, জেঠু (নীলাদ্রির বাবা নীলরতন সিংহ) ওকে বারণ করেছিলেন ডাকাতদের বাধা দিতে। কিন্তু ও ছাড়তে চায়নি। এটায় আমি অবাক নই। কারণ, আমি জানি ও খুবই জেদি। যেটা আমার, সেটা আমার! আমি দেব কেন? তাই ও একটা ডাকাতের বন্দুক কেড়ে নিতে গিয়েছিল।’’ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজও দেখেছেন শুভ্র। তাঁর কথায়, ‘‘ওর বাবা বলেছিলেন, যা নেয় নিতে দে। কিন্তু ও সমানে বাধা দিয়ে যায়। ডাকাতরা বন্দুক বার করার পরেও ওর বাবা ওকে সরে যেতে বলেন। কিন্তু ওর মনে ওটাই ছিল— কেন নিতে দেব!’’ ঠিক কী ঘটেছিল? শুভ্র বলেন, ‘‘তিন জনের কাছে সম্ভবত বন্দুক ছিল। নীলাদ্রি বাধা দিতে গেলে ওর বাবাও এক জনের বন্দুক কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। ও চেষ্টা করছিল, যাতে বন্দুকের নলটা উপর দিকে করা যায়। তখনই পাশের জন গুলি চালায়।’’

পাড়ায় ‘চারমূর্তি’ বলেই ডাকতেন সকলে। অকালমৃত নীলাদ্রি এত ভাল গান গাইতেন যে, বন্ধুরা সোনু নিগমের নামের সঙ্গে মিলিয়ে ‘নীলু নিগম’ বলে ডাকতেন। একসঙ্গে গান গাইতেন, টিউশন পড়তে যেতেন, পুজোয় ঠাকুর দেখতে যেতেন। দুর্গাপুজোর নবমীর দিন নিয়ম করে বিরিয়ানি খেতে যেতেন। সে সবই এখন অতীত। চারমূর্তি আর নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Shootout Barrackpore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE