Advertisement
১৯ মে ২০২৪

‘শীতলতম’ দিনেও দূরে দাপুটে শীত

আবহাওয়া দফতর বলছে, শীতলতম দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নীচে নামা তো দূরের কথা, স্বাভাবিকের কোঠা ছুঁয়েছে বেশ কষ্ট করে!

শীত-সওয়ারি: বুধবার বিকেলে ময়দানে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

শীত-সওয়ারি: বুধবার বিকেলে ময়দানে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:১৭
Share: Save:

পারদের পতন-প্রতিভাই শীতকে দাপট দেখানোর সুযোগ করে দেয়। কিন্তু সেই পারদও এ বার কেমন যেন পতনবিমুখ! এতটাই যে, ‘শীতলতম’ দিনেও সে স্বাভাবিকের নীচে নামেনি।

অথচ শীতকালে রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিক নয়, স্বাভাবিকের নীচে থাকাটাই দস্তুর। পারদ স্বাভাবিকের নীচে যদি নামে, তবেই দেখা মেলে প্রকৃত শীতের। তার পরে আসে শীতলতম দিনের তকমা দেওয়ার পালা। সেই জায়গায় হাওয়া অফিসের বিচারে চলতি মরসুমে এ-পর্যন্ত বুধবারই ছিল কলকাতার শীতলতম দিন। কিন্তু মহানগরে রাতের পারদ থিতু হয়েছে ১৩.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা এই সময়ের স্বাভাবিক। আবহাওয়া দফতর বলছে, শীতলতম দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নীচে নামা তো দূরের কথা, স্বাভাবিকের কোঠা ছুঁয়েছে বেশ কষ্ট করে! দক্ষিণবঙ্গের শীতপ্রবণ জেলা বীরভূম, বাঁকুড়াতেও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের নীচে নামেনি।

পতনের পরীক্ষায় পারদ কোনও মতে স্বাভাবিকের ঘরে পৌঁছে টায়েটুয়ে পাশ করেছে, এমন একটা দিনকে ‘শীতলতম’ তকমা দিতে হচ্ছে! শিক্ষামানের অবনমনের হাওয়া লাগল কি প্রকৃতিতেও!?

আবহবিজ্ঞানীদের বক্তব্য, এটা মোটেই শীতের চেনা চরিত্র নয়। তা হলে কি বদলে যাচ্ছে শীতের চরিত্র?

আবহবিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, বর্ষার চরিত্রে ইতিমধ্যেই পরিবর্তন শুরু হয়েছে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে বর্ষাকালে নিয়মিত বর্ষণ হচ্ছে না। কোনও নিম্নচাপ হাজির হলে এক ধাক্কায় তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। রাজস্থানে মরু এলাকা বলে চিহ্নিত জয়সলমেরে কয়েক বছর ধরে অতিবৃষ্টি চলছে! এ বার বদলের প্রবণতা ধরা পড়ছে শীতের ক্ষেত্রেও। এমন ধারা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কৃষি উৎপাদন ব়ড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।

জলবায়ু বদলের তত্ত্বে সিলমোহর না-দিলেও বর্ষা বা শীতের এই ধরনের ‘অস্বাভাবিক’ চরিত্র নজর এড়ায়নি কেন্দ্রীয় ভূবিজ্ঞান মন্ত্রকেরও। চরিত্র বদলের এই প্রবণতা কেন, আরও নিখুঁত ভাবে সেটা যাচাই করতে চাইছে তারা। ভূবিজ্ঞান মন্ত্রকের সচিব মাধবন রাজীবন সম্প্রতি কলকাতায় এসে জানান, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ুতে বদল আসছে কি না, তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন তাঁরা।

পরিবেশবিদদের মতে, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবেই বদল আসছে জলবায়ুতে। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীন সংস্থা ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি)-এর রিপোর্টেও সে-কথা জানানো হয়েছে। আবহবিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদেরা বলছেন, ভারতে বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু রয়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে এক-একটি এলাকায় আলাদা আলাদা বদল দেখা যাচ্ছে।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওশানোগ্রাফিক স্টাডিজের অধ্যাপক সুগত হাজরা জানান, পূর্ব ভারতে নিয়মিত বর্ষার বদলে নিম্নচাপের উপরে ভরসা করতে হচ্ছে। রাজস্থানের মরু এলাকাতেও অতিবৃষ্টি হচ্ছে। আবার দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে খরা বা়ড়ছে। জলবায়ুর বৈচিত্র রয়েছে বাংলাতেও। সেখানেও ধরা পড়ছে প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা। সুগতবাবুদের গবেষণায় উঠে এসেছে, শুখা পুরুলিয়ায় খরার দাপট বাড়ছে। এবং দক্ষিণবঙ্গের একাংশ হয়ে উঠছে নিম্নচাপ-ঘূর্ণিঝড় প্রবণ। উত্তরবঙ্গের তরাই-ডুয়ার্সেও স্বাভাবিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ঊর্ধ্বমুখী।

এই বদলের পরিণামে মরসুমি আনাজ চাষের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে। কৃষি-আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, শীতকালে তাপমাত্রা না-নামায় ফুলকপির ফুল আসতে সমস্যা হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে পেঁয়াজ চাষের। আর বর্ষার চরিত্র বদলের প্রবণতায় প্রতি বছরই ধান চাষ মার খাচ্ছে। অতিবৃষ্টি হলে সামগ্রিক ভাবেই চাষের ক্ষতি। ‘‘সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে অতিবৃষ্টির ফলে নষ্ট হচ্ছে পাকা ধান,’’ পর্যবেক্ষণ এক কৃষি-আবহবিদের।

শীতের এত বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত শুনে শীতপ্রত্যাশী বাঙালি মুষড়ে পড়তেই পারেন। এ বারেই উত্তুরে হাওয়ার দুর্বল দশা নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই। তবে এই আকালের দিনেও কিছুটা আশ্বাসবাণী শোনাচ্ছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। সেখানকার অধিকর্তা গণেশকুমার দাস বলছেন, ডিসেম্বরে শীত বেশ ঝিমিয়েই ছিল। তবে ইদানীং তার মধ্যে একটু গা-ঝাড়া দেওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহেই ১২ ডিগ্রির কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারে কলকাতার তাপমাত্রা। জেলাগুলিতে আরও একটু বেশি শীত মালুম হবে।

পারদ যদি আরও নামে, সেই শীত কি মকরসংক্রান্তি পর্যন্ত মিলবে?

এখনই এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারছেন না আবহবিদেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Winter Lowest Temperature Weather শীত
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE