Advertisement
E-Paper

দাবি ছিল সামান্যই, সেটুকু মানতে ১৪ দিন!

পড়ুয়াদের আমরণ অনশন, প্রাণ সংশয়, উদ্বেগ, আশঙ্কার ৩৩৬ ঘণ্টা পর ছাত্রদের দাবির সামনে মাথা নোয়ালেন কর্তৃপক্ষ।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৮ ১৮:০৪
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অনশনকারী পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অনশনকারী পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র।

কলেজের পুরনো হস্টেলের দৈন্য দশা। থাকার অযোগ্য। তাই নতুন হস্টেলে প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের সঙ্গে থাকতে দিতে হবে সিনিয়রদেরও। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়াদের দাবি ছিল এটুকুই। তবু তা মানতে দীর্ঘ ১৪ দিন সময় লেগে গেল মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের!

পড়ুয়াদের আমরণ অনশন, প্রাণ সংশয়, উদ্বেগ, আশঙ্কার ৩৩৬ ঘণ্টা পর ছাত্রদের দাবির সামনে মাথা নোয়ালেন কর্তৃপক্ষ। কাটল হস্টেল জট।

কিন্তু পড়ুয়াদের এই দাবি মানতে এত দেরি কেন? এই ক’দিন ঠিক কোন পথে চলছিল মেডিক্যাল কলেজ?

এমনিতেই মেডিক্যাল কলেজের পুরনো হস্টেলের অবস্থা সঙ্গীন। বৃষ্টিতে ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে, ব্যবহারের অযোগ্য শৌচাগার, আবর্জনার স্তূপ চার পাশে। অন্য দিকে, যাতায়াত, পড়াশোনা-থাকা-খাওয়ার আর্থিক সুবিধা ও গ্রুপ স্টাডির সহায়তা পেতে কলেজ হস্টেলই শিক্ষার্থীদের শেষ ভরসা। অথচ, চোখের সামনে নতুন ১১ তলা কলেজ হস্টেল তৈরি হলেও মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র নির্দেশ অনুযায়ী, তাতে কেবল প্রথম বর্ষের পড়ুয়ারা জায়গা পাবে— এমন ঘোষণা হলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন পড়ুয়াদের একাংশ।

আরও পড়ুন: ১৪ দিন পর জেদ ভাঙল কর্তৃপক্ষের, মেডিক্যালে অনশন ভাঙলেন ছাত্ররাও

প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা যাতে র‌্যাগিংয়ের শিকার না হয়, সে জন্য এমসিআই তাঁদের আলাদা থাকার বন্দোবস্ত করেন। কিন্তু যেখানে হস্টেলের অপ্রতুলতা, সেখানে এই অদ্ভুত নিয়মের কাছে নতিস্বীকার করতে রাজি হন না সিনিয়র ছাত্রছাত্রীরা। তাই নতুন হস্টেলেই থাকতে দেওয়ার দাবিতে ১০ জুলাই আমরণ অনশনের ডাক দেন ৬ জন পড়ুয়া। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ তখন উচ্ছ্বল ভদ্র।

৫ দিন কেটে যায়, কোনও রফাসূত্র মেলে না। পাশাপাশি ওই পাঁচ দিনেই নানা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে অনশনরত শিক্ষার্থীদের অনশন আন্দোলনের ছবি। গত ১৪ জুলাই সমাধান সূত্রের সন্ধানে অধ্যক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেন পড়ুয়ারা। নতুন ভবনে তাঁদের থাকতে দেওয়া হবে না এ কথা সটান জানিয়ে দেন অধ্যক্ষ উচ্ছ্বল ভদ্র। অনশনে অনড় থাকেন প়ড়ুয়ারাও।

১৫ জুলাই উচ্ছ্বল ভদ্রের পরিবর্তে নতুন অধ্যক্ষ হিসাবে যোগ দেন রামানুজ সিংহ। পরের দিন তাঁর সঙ্গেও বৈঠকে বসেন ছাত্রছাত্রীরা। সেই বৈঠক থেকেও মেলেনি কোনও রফাসূত্র। ১৬ জুলাই অনশনরত দুই ছাত্র অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেখানে যোগ দেন আরও দুই ছাত্র। ১৭ জুলাই কলেজের গোটা পরিস্থিতি জানিয়ে স্বাস্থ্যভবনে রিপোর্ট পাঠান অধ্যক্ষ। তাতেও জট কাটেনি।

ইতিমধ্যে কয়েক জন ছাত্রের অভিভাবকও এসে পৌঁছন কলেজ চত্বরে। সন্তানদের সঙ্গে তাঁরাও যোগ দেন এই অনশনে। মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকে একহাত নেন সোশ্যাল সাইটের নেটিজেনরাও। এই অনশনকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলেও প্রচার চালান রাজনীতিকদের একাংশ। তাতেও নিজেদের জেদ ও দাবি থেকে সরেননি পড়ুয়ারা। ক্রমেই ছাত্রদের সঙ্গে অনশনে সামিল হতে শুরু করেন ছাত্রীরাও।

আরও পড়ুন: ‘মমতাও মহিলা, কষ্টটা বুঝবেন’, প্রার্থনা দেবাশিসের মায়ের​

প্রাণ হাতে করে এই ভগ্নপ্রায় হস্টেলেই দিন কাটাত কলকাতা মেডিক্যালের পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র।

১৮ জুলাইও জটিলতা না মেটায় ১৯ তারিখ থেকে আরও ১৫ জন পড়ুয়া সামিল হন অনশনে। ইতিমধ্যেই অনশনের জেরে রক্তচাপ নেমে যেতে শুরু করে ছাত্রদের, রক্তে শর্করার পরিমাণ কমতে থাকে হু হু করে। অসুস্থ হয়ে পড়েন আরও দু’জন। প্রায় মৃত্যুমুখে চলে যাওয়া পড়ুয়ারাদের দেখেও দাবি না মানার জেদে অনড় থাকেন অধ্যক্ষ রামানুজ সিংহ। ‘উপর মহল’ থেকে নির্দেশ না এলে তাঁর করণীয় কিছু নেই— সে কথা জানিয়ে দেন তিনি।

এই পরিস্থিতিতে গত ২০ জুলাই রামানুজ সিংহের জায়গায় অধ্যক্ষ হিসাবে যোগ দেন অশোক ভদ্র। সে দিনই মেডিক্যাল কলেজের চারটি হস্টেল পরিদর্শন করেন স্বাস্থ্যভবনের দুই অধিকর্তা। অশোকবাবু ক্ষমতায় এসেই ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠকে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কলেজে বৈঠকও হয়। তখন থেকেই নতুন অধ্যক্ষের ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজের’ উপর ক্ষীণ আস্থা রাখতে শুরু করেছিলেন অনশনরত পড়ুয়ারা।

২১ জুলাই স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্যের সঙ্গে ৩ জন ছাত্র প্রতিনিধিকে নিয়ে বৈঠকে অংশ নেন তিনি। ২২ জুলাই স্বাস্থ্যভবনের তরফে নতুন হস্টেলে থাকার দাবি এক প্রকার নাকচ করে জানিয়ে দেওয়া হয়, পুরনো হস্টেল সারিয়ে তা বাসযোগ্য করে সেখানেই শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। ওই দিনই দেবাশিসবাবু মন্তব্য করেন, এটা পড়ুয়াদের ‘প্রতীকী অনশন আন্দোলন’। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার ‘প্রতীকী অনশন আন্দোলন’ মন্তব্য যেন আন্দোলনের আগুনে ঘি দেয়। সোশ্যাল সাইটে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

আরও পড়ুন: জঞ্জাল যন্ত্রণা! এই হস্টেলে থাকা যায়?

ওই দিনই মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়ে গণ কনভেনশনে অংশ নেন সমাজের নানা স্তরের বিশিষ্ট মানুষ। সেই ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। আন্দোলনরত ছাত্রদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে বিবৃতি দেন শঙ্খ ঘোষ। পড়ুয়াদের পাশে এসে দাঁড়ান বিদ্বজ্জনদের একাংশ।

অবশেষে ২৩ জুলাই দুপুরে মেডিক্যাল কলেজ কাউন্সিলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন অধ্যক্ষ অশোক ভদ্র। সমস্যা সমাধানে আশু পদক্ষেপ করার কথাও তিনি জানান। ওই বৈঠকেই কাটে জট। পড়ুয়াদের লাগাতার অনশনের মুখে নত হন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। জানিয়ে দেওয়া হয়, নতুন হস্টেলের দু’টি তলা ছেড়ে দেওয়া হবে সিনিয়র পড়ুয়াদের।

তা হলে কি তুচ্ছ দাবিও এ বার আদায় করতে হবে অনশনের পথ ধরেই? প্রশ্নটা করছেন পড়ুয়াদের একাংশই।

Calcutta Medical College Kolkata মেডিক্যাল কলেজ Student Movement Hunger Strike
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy