হরিপদ হালদার এবং সুদীপ দীক্ষিত। নিজস্ব চিত্র
৬৮ মিটার লম্বা মই, যার দাম প্রায় দু’কোটি টাকা। দমকলের একটি ছোট ইঞ্জিন, গড়ে দু’ঘণ্টা কাজ করলে সব মিলিয়ে তার জন্য খরচ আট থেকে দশ হাজার টাকা। দু’দফায় এমন চারটি ইঞ্জিন গিয়েছিল মার্জার উদ্ধারে। অথচ রাজকীয় এই আয়োজন হার মেনেছিল একটি ঝাঁকা, দড়ি, কয়েক টুকরো মাছ, ধৈর্য আর উপস্থিত বুদ্ধির কাছে।
আর তাই খন্না এলাকার বহুতলে আটকে থাকা সেই বেড়াল গত বৃহস্পতিবার, আট দিনের মাথায় ফিরতে পেরেছিল তার চেনা পরিবেশে। ওই বহুতলে বেড়াল আটকে থাকার খবরটি সামনে এসেছিল অভিনেতা-অভিনেত্রী তথাগত মুখোপাধ্যায় ও দেবলীনা দত্তের ফেসবুক পোস্টে। তার পরেই সংবাদমাধ্যমে বেড়ালের খবর প্রকাশিত হয়।
কিন্তু যে মার্জার উদ্ধারে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন দমকলের কর্মীরা, এমনকি পর্বতারোহীও, সেই ‛অসাধ্যসাধন’ করে গোটা উদ্ধার পর্বের নায়ক হয়ে উঠেছেন বছর পঞ্চাশের হরিপদ হালদার। মাছ আর জলের টোপ রেখে বহুতলের তিনতলার ওই ফাঁকের সামনে কপিকল দিয়ে ঝাঁকা ঝুলিয়ে অবশেষে তিনি উদ্ধার করেছিলেন বেড়ালটিকে। আর এ কাজে তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা সুদীপ দীক্ষিত।
ত্রাতা: এ ভাবেই বেড়ালটিকে টোপ দিয়েছিলেন হরিপদ হালদার এবং সুদীপ দীক্ষিত। নিজস্ব চিত্র
কে এই হরিপদবাবু? তিনি কলকাতা পুরসভার ধাপা ডগ পাউন্ডের কর্মী। পশু উদ্ধারের প্রশিক্ষণ তাঁর ঝোলায় নেই। তবু যখন আশপাশের লোকের মুখে বেড়াল আটকে থাকার কথা শোনেন, চুপ করে থাকতে পারেননি। যে এলাকায় বেড়ালটি আটকে পড়েছিল, তার কাছেই মোহনবাগান লেনের ঘুপচি ঘরে ছেলেকে নিয়ে থাকেন তিনি। স্ত্রী গত হয়েছেন ৯ বছর আগে। মাসিক ছ’হাজার টাকা বেতনে ডগ পাউন্ডে গত ৬ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। জয়পুরিয়া কলেজ থেকে পাশ করা স্নাতক ছেলেকে চাকরিতে থিতু করার স্বপ্ন দেখছেন এখন। তাঁর পুঁজি বলতে আমেরিকা বাসের চার মাস। হরিপদবাবু বলছেন, ‘‘তখন কাঠের কাজ, মণ্ডপ তৈরি করতাম। সেই সূত্রে দিল্লি, মুম্বই, গুজরাতে যেতাম। গুজরাতের স্বামীনারায়ণ মন্দিরে কাজের সূত্রে প্রায় এক বছর ছিলাম। সেই মন্দির কমিটির তরফেই ১৯৯১ সালে নিউ ইয়র্কে পাঠানো হয় আমাকে। ভারত ও আমেরিকার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত মেলার মণ্ডপের কাজ করতে গিয়েছিলাম। কাজ শেষে আমেরিকা থেকে পাঁচ ভরি পাঁচ আনা ওজনের রুপোর মেডেল পেয়েছিলাম।” কাজের স্বীকৃতিতে দেশের মাটিতেও রুপোর পদক পেয়েছেন। হাজার অভাবেও সে দু’টি আগলে রেখেছেন তিনি। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পরে সন্তানদের মুখ চেয়ে মণ্ডপ তৈরির কাজ ছেড়ে দেন হরিপদবাবু। বৈচিত্রময় জীবনের এই লড়াই তাঁকে শিক্ষা দিয়েছে সামান্য জীবকেও তুচ্ছ না করার। যার কাছে নত হতে হয় ঠান্ডা ঘরের নরম বিছানায় শুয়ে ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে থাকার শিক্ষা।
আরও পড়ুন: উৎসব মিটেছে, পথে রয়ে গিয়েছে মণ্ডপ ও হোর্ডিং
যদিও স্মার্ট ফোন হাতে নিয়ে ঘোরা মধ্য কুড়ির যুবক সুদীপ আটকে পড়া বেড়ালের থেকে মুখ ফেরাতে পারেননি। যে বহুতলে বেড়ালটি আটকে পড়েছিল, তার উল্টো দিকেই থাকেন সুদীপ। আদত বাড়ি বর্ধমান। একটি শাড়ির সংস্থায় কাজের সূত্রে খন্না এলাকায় থাকেন।
আরও পড়ুন: মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে জল সমস্যায় নজর
তিনিই প্রথম বেড়ালের কান্না শুনেছিলেন। হরিপদবাবু ও সুদীপ নানা ভাবে বেড়ালটিকে টোপ দিয়ে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। সুদীপ জানাচ্ছেন, এ জন্য আশপাশের বাসিন্দাদের বিদ্রুপও কম শুনতে হয়নি তাঁদের। রাত জেগে থাকার ফলে কর্মক্ষেত্রে যেতে দেরি হলে সহকর্মীরাও বাঁকা কথা শোনাতেন। কিন্তু বেড়াল বাঁচাতে জেদ চেপে গিয়েছিল দু’জনেরই। সুদীপের কথায়, ‘‘আমাকে দেখলেই ম্যাও ম্যাও করত। যে দিন ওকে নেমে লেজ তুলে দৌড়তে দেখলাম, সে দিন আনন্দে খুব নেচেছিলাম, পুজোর ভাসানেও এত নাচিনি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy