Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Sikharani Bag

খুদেদের নাচ শিখিয়েই দিন গুজরান বড় পর্দার ‘লক্ষ্মীবাঈ’য়ের

প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পরে আবার বিয়ে করেন শিখা। দ্বিতীয় স্বামী মারা যান আশির দশকে। নিঃসন্তান শিখা দমদম ক্যান্টনমেন্টের ফ্ল্যাটে এখন একাই থাকেন।

Jhansi ki rani movie 1953 actress Sikharani Bag

দিদিমণি: ছোটদের নাচের ক্লাসে শিখা বাগ। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।

আর্যভট্ট খান
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৩ ০৭:১৮
Share: Save:

বয়স ৮১ ছুঁয়েছে। কিন্তু এই বয়সেও অসুখ ছুঁতে পারেনি বড় পর্দার ‘লক্ষ্মীবাঈ’কে। এখনও তিনি কচিকাঁচাদের নাচের দিদিমণি।

দমদম ক্যান্টনমেন্টের পি কে গুহ রোডের মডার্ন পার্কের এক কামরার ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটেই চলে তাঁর ভরতনাট্যম, রাবীন্দ্রিক ও সৃজনশীল নাচের প্রশিক্ষণ। সেখানেই ভরতনাট্যমের কঠিন কঠিন মুদ্রা ছোটদের যত্ন করে শেখান অশীতিপর শিখারানি বাগ। তাঁকে কি আদৌ চেনে আজকের প্রজন্ম? কঙ্গনা রানাওয়াত অভিনীত সাম্প্রতিক সিনেমা ‘ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ’ হওয়ার অনেক আগে, ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল হিন্দি ছবি ‘ঝাঁসি কি রানি’। সেই ছবিতে স্বয়ং লক্ষ্মীবাঈয়ের মেয়েবেলার ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল ছোট্ট শিখাদেবীকে। তার পরে ১৯৪৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০টির মতো বাংলা ছবিতে শিশু ও কিশোরীর একাধিক চরিত্রে চুটিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি।

বড় পর্দার সেই সব সোনালি দিন কি মনে পড়ে? শিখা বলছেন, ‘‘তিন বছর বয়স থেকে নাচ শিখেছি। মানিকতলায় থাকতাম, বাড়িতে নাচ-গানের পরিবেশ ছিল। আমার আবৃত্তি শুনে তখনকার অগ্রদূতের কর্ণধার বিভূতি লাহা বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আমায় তাঁর ছবি ‘সংকল্প’-এ শিশুশিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করান। তখন আমি পাঁচ-ছ’বছর। এর পরে ১৯৪৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত বহু বাংলা ছবিতে কাজ করেছি। জহর গঙ্গোপাধ্যায়, মলিনা দেবী, কমল মিত্র, কানন দেবী, অনুপ কুমার, জয়নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ী স্যানাল, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ সব প্রধান অভিনেতাদের সঙ্গেই কাজ করেছি। কানন দেবীর সঙ্গে ‘মেজদিদি’ খুব হিট করেছিল। ওটা আমার খুব প্রিয় ছবি।’’

বলিউডের পরিচালক সোহরাব মোদী শিশুশিল্পী চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। তা থেকেই ওই ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ মিলেছিল শিখার। তবে এ জন্য শুধু হিন্দি নয়, রীতিমতো ঘোড়ায় চড়াও শিখতে হয়েছিল তাঁকে। ছবির স্ক্রিনিংয়ের দিন হাজির ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, লালবাহাদুর শাস্ত্রী। ‘‘নেহরু ছবি দেখে আমার অভিনয়ের প্রশংসা করেছিলেন।’’— স্মৃতিমেদুর শিখা।

শিখার একচিলতে ফ্ল্যাটের দেওয়ালে, ড্রেসিং টেবিলে, ফ্রিজের উপরে রাখা তাঁর অভিনয় জীবনের টুকরো টুকরো ছবি। তা দেখাতে দেখাতে বৃদ্ধা বলে চলেন, ‘‘সংকল্প, মেজদিদি, রূপান্তর, রানি রাসমণি, বলয়গ্রাস, নীলাচলে মহাপ্রভু, মাথুর, মা শীতলা, বাস্তব, সাধক রামপ্রসাদ— এই সব ছবিতে শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছি। সুচিত্রা সেনের অগ্নিপরীক্ষা, শিল্পী ছবিতে তাঁর ছোটবেলার ভূমিকায় আমি ছিলাম। সিনেমার ছোট সুচিত্রাকে খুব ভালবাসতেন বাস্তবের সুচিত্রা সেন।’’ তবে অভিনয়ের পাশাপাশি, নাচও চলেছিল সমান তালে।শিখার কথায়, ‘‘তখন শিশুশিল্পীর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। তাই আমার নাম হয়েছিল খুব। সিনেমায় অভিনয় করা নিয়ে তখন সমাজে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। এখনকার মতো সহজ ছিল না।’’

এত নাম সত্ত্বেও কেন তাঁর অভিনয়-জীবন শেষ হয়ে গেল মাত্র ১৯ বছর বয়সেই? শিখার শেষ অভিনীত ছবি ১৯৬১ সালে ‘মায়ার সংসার’। তখন তাঁর বয়স ১৯। শিখা বলেন, ‘‘বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়িতে আপত্তি ছিল। তাই মনে হল, অভিনয় ছেড়ে দিয়ে সংসার করি। তার পরেই নাচের স্কুল নৃত্যালোক খুলি। সিনেমা ছাড়া নিয়ে অবশ্য আমার কোনও আফশোস নেই।’’

প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পরে আবার বিয়ে করেন শিখা। দ্বিতীয় স্বামী মারা যান আশির দশকে। নিঃসন্তান শিখা দমদম ক্যান্টনমেন্টের ফ্ল্যাটে এখন একাই থাকেন। কিন্তু নিজেকে কখনও ‘একা’ ভাবেন না। বলেন, ‘‘একা কোথায়? আমার নাচের স্কুলের এত ছাত্রী রয়েছে। আমার তো দম ফেলার ফুরসত নেই।’’ বয়স ৮০ পেরোলেও অসুস্থতা কাবু করতে পারেনি বৃদ্ধাকে। বলেন, ‘‘সংযমী জীবনযাপন করি। ঘরের সব কাজ নিজেই করি। তাই আজও আমি সুস্থ। যা পেয়েছি, তাতেই তৃপ্ত। কারও প্রতি কোনও অভিযোগ নেই।’’

এখনও কি সুযোগ এলে অভিনয়ের জগতে ফিরবেন? বাংলার সিরিয়াল জগৎ থেকে ডাক আসে না? অভিমান ঝরে পড়ে বৃদ্ধার গলায়। বলেন, ‘‘এখন আমার সেই ভাবে কোনও বন্ধন নেই। কিন্তু আমায় তো কেউ ডাকে না। আমাকে বোধহয় ভুলেই গিয়েছে আজকের প্রজন্ম।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dumdum Cantonment Bharatnatyam
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE