E-Paper

মাথায় থাকা হেলমেটটাই এই যাত্রায় আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে

মেয়ো রোড দিয়ে এমনিতেই দ্রুত গতিতে বাস চলে। বাসের চালকেরা অনেকেই আবার নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করেন। এ দিন তেমনই একটি বাস হঠাৎ পিছন থেকে ধাক্কা মারে আমার মোটরবাইকে।

অমিত মারিক

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৫৯
A Photograph of the man who affected due to accident

দুর্ঘটনায় আহত অমিত মারিক। নিজস্ব চিত্র।

কী ভাবে যে প্রাণে বেঁচে গিয়েছি, এখনও যেন বুঝে উঠতে পারছি না! হঠাৎ মনে হল, পিছন থেকে কিছু একটা ধাক্কা মারল। মোটরবাইক নিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়লাম। চোখে-মুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। এর পরে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে যা দেখলাম, সেটা মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো দৃশ্য। চোখের সামনেই এক পাশে উল্টে পড়ে আছে একটা মিনিবাস। চাপ চাপ রক্ত আশপাশে। বাসের তলায় চাপা পড়ে রয়েছেন এক জন। তাঁর কোমর থেকে শরীরের উপরের অংশ বাসের পেটের ভিতরে, পা-টা শুধু বাইরে বেরিয়ে আছে। অনেকে বাসের ভিতর থেকে চিৎকার করছেন! উঠে গিয়ে যে সাহায্য করব, তখন সেই ক্ষমতাও নেই। সারা শরীর অবশ লাগছে!

শনিবার কাজের সূত্রে মোটরবাইক নিয়ে গিয়েছিলাম ধর্মতলার মেট্রোগলিতে। সেখান থেকে মেয়ো রোড ধরে দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে হাওড়ার পাতিয়ালে নিজের বাড়িতে ফেরার কথা ছিল। আমার দুই মেয়ে বায়না ধরেছিল, আজ যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি। ডাফরিন রোড হয়ে মেয়ো রোডে ঢোকার সময়েই ঘটল বিপত্তি। মেয়ো রোড দিয়ে এমনিতেই দ্রুত গতিতে বাস চলে। বাসের চালকেরা অনেকেই আবার নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করেন। এ দিন তেমনই একটি বাস হঠাৎ পিছন থেকে ধাক্কা মারে আমার মোটরবাইকে। পরে বুঝেছি, মেটিয়াবুরুজ থেকে হাওড়াগামী ওই বাসটির ডাফরিন রোড হয়ে হাওড়ার দিকে যাওয়ার জন্য বাঁ দিকে ঘোরার কথা ছিল। কিন্তু, তার বদলে বাসটি কেন ওই ভাবে সম্পূর্ণ ডান দিকে ঘুরে গেল, বুঝলাম না। ডান দিকে ঘুরেই আমাকে ধাক্কা মেরেছে। কেউ বলছেন, ওই বাসে কোনও যান্ত্রিক গোলযোগ হয়ে থাকতে পারে। কেউ বলছেন, অন্য বাসের সঙ্গে রেষারেষি করার সময়েই সামনে একটি মোটরবাইক পড়ে যায়। সেটিকে কাটাতে গিয়েই টাল সামলাতে না পেরে ডান দিকে ঘুরে উল্টে গিয়েছে বাস!

বাস থেকে বার করে আনা হচ্ছে আহত এক যাত্রীকে। শনিবার, মেয়ো রোডে।

বাস থেকে বার করে আনা হচ্ছে আহত এক যাত্রীকে। শনিবার, মেয়ো রোডে। নিজস্ব চিত্র।

মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরে কিছু ক্ষণ আমার জ্ঞান ছিল না। পরে দেখি, ডান কাঁধ নাড়াতে পারছি না। কিন্তু আমার চোট অন্যদের তুলনায় কিছুই নয়। বাসটি উল্টে যাওয়ার সময়ে সম্ভবত একটি মোটরবাইককে দুমড়ে দেয়। সেটির চালক রাস্তায় ছিটকে পড়েন। বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিই বাসের তলায় চাপা পড়ে যান।

এর পরে আশপাশের লোকজন এবং পুলিশকর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে কোনও মতে বাসের কাচ ভাঙতে শুরু করেন। চালকের দিকের কাচ এবং পিছন দিকের কাচ ভাঙা হয়। বাসটি বাঁ দিকে উল্টোনোয় ডান দিকের কাচ ভেঙেও অনেককে বার করা হয়। তত ক্ষণে ঘটনাস্থলে পুলিশের অ্যাম্বুল্যান্স এসে গিয়েছে। এক-এক জনকে তুলে কোনও মতে তাতে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। তবে, বাসের তলায় যিনি চাপা পড়েছিলেন, তাঁর অবস্থা ছিল সব চেয়ে গুরুতর। পরে খোঁজ পেয়েছি, সব মিলিয়ে ১৯ জনকে এসএসকেএমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে দু’জনের মৃত্যু হয়। মৃতদের মধ্যে এক জনের বয়স শুনছি ১৬ বছর! পুলিশ এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যেরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে বাসটিকে দ্রুত সোজা না করলে কী হত, বলা যায় না। পরে বাসটি পুলিশ সরিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু, বাসের চালক এবং কন্ডাক্টরের কী হল, জানি না। পুলিশ ওঁদের খোঁজ পেয়েছে কি না, সেই খবরও পাইনি।

বাসটি যে মোটরবাইকে ধাক্কা মেরেছিল, সেটির সামনের অংশ বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। নিজে মোটরবাইক চালাই বলে জানি, কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে এমন ঘটনা। আমার মাথায় থাকা হেলমেটটাই এই যাত্রায় আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যার পরে শ্যালকের সঙ্গে তাঁর মোটরবাইকে কোনও মতে বাড়ি ফিরেছি। আমার বাইকটা ভাল রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্ত্রী এবং মেয়েদের অতটা বলিনি, কী হয়েছিল। কিন্তু, ভেঙে যাওয়া আমার হেলমেটটা সারা জীবন মনে করাবে, কী রকম দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরলাম!

(বাস দুর্ঘটনায় জখম বাইক-আরোহী)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bus Accident Road Accident Helmet Bike

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy