Advertisement
E-Paper

মৃতদের দেশ ছুঁয়ে থাকে চির হেমন্তের বিষাদ

একটি বিশাল পুকুর অবশ্য পানা-ঢাকা। তার গায়ে বিপজ্জনক ভাবে ঝুঁকে থাকে ভাঙাচোরা দু’টি কবরের সৌধ।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৭ ০০:৫৩
অতীত: কবর ছুঁয়ে প্রিয়জনের স্মরণ। বাগমারি কবরস্থানে। ছবি: শৌভিক দে

অতীত: কবর ছুঁয়ে প্রিয়জনের স্মরণ। বাগমারি কবরস্থানে। ছবি: শৌভিক দে

বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের এক বিচারপতি এসেছিলেন পাঁচিল-ঘেরা এই শান্ত বাগানে।

‘‘আমার বাবার এখানেই মাটি হয়েছিল। উনি এই গোরস্থানের কর্মীও ছিলেন, এক বার দেখাবেন ওঁর ঘরটা! কত খেলেছি, পড়াশোনা করেছি ওখানে আমি!’’ বাগমারির মুসলিম বেরিয়াল গ্রাউন্ডের সাব-রেজিস্ট্রার হায়দার আলি খান এ সব পুরনো গল্প বলছিলেন এক নিস্তব্ধ দুপুরে। কাঁকুড়গাছি এলাকার নাগরিক ব্যস্ততার মধ্যে এই বাগান যেন এক অন্য পৃথিবী।

অনেকেই জানেন না, বাগমারির এই মুসলিম কবরস্থানই কলকাতার সব থেকে বড় সমাধিক্ষেত্র। ঢুকতেই পুরসভার বোর্ড। সেখানে লেখা, ১৪৭ বিঘার এই কবরস্থান শুধু কলকাতা বা ভারতের নয়, এশিয়ার সব থেকে বড় সমাধিক্ষেত্র। বয়সেও এটাই কলকাতার প্রাচীনতম, ৪০০ বছরেরও পুরনো। কলকাতার গোরস্থান-বিশেষজ্ঞ, লেখক তথা উর্দু কাগজের সাংবাদিক শাকিল আফরোজ অবশ্য বয়সের দাবি বা ‘এশিয়ার বৃহত্তম’ তকমাটা মানতে চাইলেন না। বললেন, কোনও প্রমাণ নেই। বয়সের প্রাচীনত্বেরও নথি নেই বাগমারিতে। তাঁর মতে, ‘‘বিক্ষিপ্ত ভাবে বহু আগে থেকে মাটি দেওয়ার রীতি থাকতেও পারে। পুরসভার নথি বলছে, গোরস্থানের জন্য জমি অধিগ্রহণের সময়কাল গত শতকের গোড়ায়।’’ তবে গোবরা, গার্ডেনরিচ বা একবালপুরের সোলানায় কলকাতার পুর এলাকার অন্য প্রধান মুসলিম সমাধিক্ষেত্রগুলির মধ্যে বাগমারির এই বাগানই সব থেকে বড়।

কলকাতার বিভিন্ন ধর্মের লোকের বেশির ভাগ সমাধিক্ষেত্রে যেমন, পুরনো কবরের সৌধে সময়ের থাবা ছাপ ফেলেছে এখানেও। কোনও সমাধির গায়ে সুদৃশ্য চাদর বিছানো। লোকবিশ্বাসে কিছু পিরবাবার মাজারও গড়ে উঠেছে। অবিভক্ত দেশে লাহৌর, সিয়ালকোট, ঢাকার অনেক পরিবারের কবরও রয়েছে এখানে। একদা দারুণ ধনী, প্রতিষ্ঠিত পরিবারের পুরনো কবরের গায়ে চোখ ধাঁধানো মিনাকারির কাজ, উর্দু-ফারসির ক্যালিগ্রাফিতে কবিতার লাইন খোদাই করা। কয়েক প্রজন্ম পরের জমানায় তাদের অবস্থাই হয়ত পড়তির দিকে। পুরনো পারিবারিক সমাধিসৌধের দশা ভাঙাচোরা, মেরামতির ক্ষমতা নেই।

শবযাত্রীদের আচার-অনুষ্ঠানের কাজে নিযুক্ত ইমামসাহেব মুফতি খালিদ আজম হায়দারি বলছিলেন, ‘‘সাধারণত কবরের গায়ে গাছ পোঁতার রীতি ছিল দীর্ঘদিন। গাছেরও তো প্রাণ আছে। ওরাও দোয়া করে। আমাদের বিশ্বাস, গাছ থাকাটা শুভ।’’১৯৩৫ সালের পুরনো কবরের মাথায় চাঁদোয়ার মতো ছেয়ে আছে লতাপাতা। নীচে মৃতের নাম, বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা। হিজরি নয়, বাংলা সন-তারিখই চোখে পড়ল।

আশির দশক থেকে প্রিয়জনের জন্য আলাদা করে কবরের জায়গা কিনে সৌধ তৈরির চল কার্যত বন্ধ। আত্মীয়-পরিবারহীন পুরনো কবরগুলির জমিও চিহ্নিত করা হয়েছে। জনসংখ্যার চাপে, মৃতদের দেশেও ঠাঁইয়ের অভাব। এখন পাঁচ বছর অন্তর কবরের জমি পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে। কবরের জন্য ৫৯টি ব্লক, দু’টি পুকুর বাগমারিতে। প্রিয়জনকে মাটি দেওয়ার আগে পুকুরে হাত-পা ধুয়ে ওজু করেন শোকার্ত আত্মীয়েরা।

একটি বিশাল পুকুর অবশ্য পানা-ঢাকা। তার গায়ে বিপজ্জনক ভাবে ঝুঁকে থাকে ভাঙাচোরা দু’টি কবরের সৌধ। পুরসভার মুসলিম বেরিয়াল বোর্ডের সেক্রেটারি মুস্তাক হুসেন বললেন, ‘‘শীঘ্রই পুকুর পরিষ্কার বা গোরস্থান সংস্কারের কিছু কাজ হবে!’’ শবে বরাতের রাতে এই কবরস্থানেই লাখো লোকের ভিড় হয়। জ্বলে ওঠে মোমের শিখা, প্রদীপ।

অতীতের পিছুটান কিংবা জীবনের নশ্বরতার একটা বোধ কিন্তু মিশেই থাকে এই হাওয়ায়। রোজ ডিউটিতে এসে নিজের মনেই চারধারে মাটির মধ্যে মিশে থাকা বিদেহীদের কথা ভেবে কিছু ক্ষণ দোয়া করেন হায়দার সাহেব। সৌম্য প্রবীণ হাসেন, ‘‘এখানে এলে মনে একটা নম্র ভাব আসে, দেখেছেন! লোকের হামবড়াই, বারফট্টাই সব উবে যায়।’’ ব্যস্ত কলকাতাকে এখানে ছুঁয়ে আছে চিরহেমন্তের বিষাদ।

Grave Muslim Burial Ground
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy