Advertisement
E-Paper

জলসায় ঝালাপালা পাড়া, ‘বধির’ পুলিশ

জলসাকে ঘিরে কয়েক জন পুলিশকর্মীও। কিন্তু হাবভাব দেখে মনে হল, রাত দশটার পরেও বেআইনি ভাবে বেজে চলা সাউন্ড বক্স বন্ধ করতে তাঁরা সেখানে আসেননি। বরং জলসার পাহারায় মোতায়েন হতে এসেছেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৭ ০২:৫৮
গানের গুঁতো: মধ্যরাতে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে তারস্বরে চলছে জলসা। কালীঘাটে। নিজস্ব চিত্র

গানের গুঁতো: মধ্যরাতে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে তারস্বরে চলছে জলসা। কালীঘাটে। নিজস্ব চিত্র

অলিগলি নয়, রাজা সুবোধচন্দ্র মল্লিক রোডের মতো শহরের দক্ষিণ প্রান্তের বড় ও ব্যস্ত রাস্তা। সুলেখা মোড়ের কাছে সেই রাস্তার ধারে তৈরি মঞ্চে জলসার ভরপুর আয়োজন। বড় বড় সাউন্ড বক্সের দৌলতে গানবাজনার শব্দ বেরোচ্ছে গাঁক গাঁক করে। এতটাই যে, আধ কিলোমিটার দূর থেকেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। রবিবার রাত তখন পৌনে ১১টা।

জলসাকে ঘিরে কয়েক জন পুলিশকর্মীও। কিন্তু হাবভাব দেখে মনে হল, রাত দশটার পরেও বেআইনি ভাবে বেজে চলা সাউন্ড বক্স বন্ধ করতে তাঁরা সেখানে আসেননি। বরং জলসার পাহারায় মোতায়েন হতে এসেছেন।

ঠিক তা-ই। সাউন্ড বক্স তাঁরা বন্ধ করছেন না কেন? পুলিশকর্মীদের এক জন বললেন, ‘‘আমাদের কাজ এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যাতে অশান্তি না হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক থাকে, সেটাই শুধু দেখা।’’ কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখা মানে কি বেআইনি কাজ চোখের সামনে হতে দেখেও পদক্ষেপ না করা? রাত দশটার পরে এই তারস্বরে শব্দ করাই তো বেআইনি! পুলিশকর্মীরা তখন চুপ।

মুম্বইয়ে এক বার গায়ক অভিজিতের দুর্গাপুজোর ফাংশনে ঊষা উত্থুপ গাইতে উঠেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গাইতে পারেননি। রাত তখন দশটা বেজে গিয়েছে। তাই মাইক খুলে নিয়েছিল পুলিশ।

কলকাতা পুলিশ অবশ্য সেটা পারে না। এ ক্ষেত্রে মোটের উপরে এখানকার সব পুলিশের দর্শন বা অবস্থান এক— ‘অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’ অর্থাৎ, অভিযোগ না পেলে স্বতঃপ্রণোদিত বা ‘সুয়ো মোটো’ ব্যবস্থা পুলিশ এ সব ক্ষেত্রে এক রকম নেয় না বললেই চলে। পুলিশ অফিসারদের একাংশের সাফাই, ‘‘বেশির ভাগ জলসাই হয় গলিঘুঁজিতে। সব খবর আমাদের কাছে আসে না।’’ যদিও রাতে বিট কনস্টেবল, বিট অফিসার তল্লাটে তল্লাটে ঘোরেন। তা সত্ত্বেও গভীর রাতে জলসার খবর থানা পায় না কেন, তার সদুত্তর পুলিশের অনেকের কাছেই নেই।

আসলে কলকাতা তথা রাজ্যের পুলিশের একটা বড় অংশ জানেই না যে, রাত দশটার পরে খোলা জায়গায় মাইক বা সাউন্ড বক্স বাজানো নিষিদ্ধ। এমনকী, আইন অনুযায়ী রাত দশটা পর্যন্তও তা বাজাতে হবে ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে।

পুলিশের কেউ কেউ যুক্তি দেন, শব্দমাত্রা সত্যিই সীমা লঙ্ঘন করেছে কি না, তা তাঁরা বুঝবেন কী করে? কিন্তু এ বার ওই যুক্তি দেওয়ার উপায় নেই। লালবাজার সূত্রের খবর, এ বার উৎসবের মরসুম শুরু হওয়ার আগেই পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে সাউন্ড লেভেল মিটার দেওয়া হয়েছে কলকাতা পুলিশকে এবং শব্দ মাপার ওই যন্ত্র শেষমেশ থানাগুলির হাতেও এসে গিয়েছে। একই সঙ্গে সাউন্ড লিমিটার বা শব্দ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রও পেয়েছে পুলিশ। যেটা মাইকে লাগালে নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ উঠতেই পারবে না।

হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশও শব্দ নিয়ন্ত্রণ ও পরিমাপের ওই সব যন্ত্র পেয়েছে। অথচ পুলিশ সূত্রের খবর, শহর ও আশপাশে সে সব নামমাত্র ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশেরই একাংশ মেনে নিচ্ছে, রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি তো আছেই। রাত দশটার পরে জলসা বন্ধ করতে উদ্যোগী না হওয়ার পিছনে সদিচ্ছার অভাবও একটা বড় কারণ।

লালবাজারের এক কর্তা যেমন বলছেন, ‘‘দেশপ্রিয় পার্ক, টালিগঞ্জ, কালীঘাট, শ্যামপুকুর ও বড়তলার কয়েকটি জলসাকে সম্প্রতি রাত ১১টা পর্যন্ত মাইক বাজাতে দেওয়া হয়েছিল। এক ঘণ্টা আমরা ছাড় দিয়েছিলাম।’’ কিন্তু রাত দশটার পরে খোলা জায়গায় মাইক বাজানোর অপরাধের শাস্তি যে পাঁচ বছর জেল বা এক লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা দু’টোই, সেই আইনি ব্যবস্থার কথা পুলিশের অনেকের জানা নেই, জানার ইচ্ছেও নেই।

পুলিশের এই গা-ছাড়া মনোভাবে জলসার আয়োজকদের পোয়াবারো। হালতুর নাজিরবাগানের ঘোষপাড়ায় শনিবার মাঝরাতের পরেও তারস্বরে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে যে জলসার ছবি ও খবর কাগজে প্রকাশিত হয়েছে, তার আয়োজকদের কেউ কেউ রীতিমতো বেপরোয়া। ঘনিষ্ঠ মহলে সোমবার তাঁদের একাংশ বলেছেন, রাত সাড়ে ১২টার পরে তো তেমন আওয়াজ ছিল না। আর গভীর রাতে মাইক না-বাজানোর নির্দেশ তো দলের উপরমহল থেকে তাঁদের দেওয়া হয়নি!

শহরের অন্য প্রান্তের এক পুলিশ অফিসারের মুখ থেকে শোনা গেল অসহায়তার কথা। বললেন, ‘‘আমরা নিষেধ করলে, বেআইনি বলে জানালেও কাজ হয় না। হাইকোর্টের নির্দেশের ভয় দেখালে কিছুটা কাজ হয়।’’

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক, বর্তমানে পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও এই শব্দদূষণ বন্ধ হচ্ছে না। এটা কিন্তু আগামী দিনে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অশনি সঙ্কেত।’’

Noise Pollution Function Sound Box সাউন্ড বক্স
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy