Advertisement
০২ মে ২০২৪
Clay Oven

বছরে আট লক্ষ মৃত্যু উনুনের দূষণে, গ্রামের পথে শহরও

নোনাডাঙার রাণু শিকদার যেমন জানালেন, নিজের হাতে লোহার বালতিতে তোলা উনুন তৈরি করেছেন এ বছর। আগে কেরোসিনে রান্না করতেন। কিন্তু যে হারে কেরোসিনের দাম বেড়েছে, তাতে সেই পথ বন্ধ।

A Photograph showing a woman is cooking on a clay oven

উনুন জ্বালিয়ে রান্না হাজার বস্তির ঘরহারা এক বাসিন্দার। মঙ্গলবার, নিবেদিতা পার্কে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৩ ০৬:৩৬
Share: Save:

দুই বাড়িতে কাজ সেরে এসে সকাল ১০টায় হাঁড়িতে চাল আর জলবসান লক্ষ্মী রুইদাস। এর পরে চাল ফুটে ওঠামাত্র হাঁড়ির মুখে চাপা দিয়ে নামিয়ে রেখে দেন তিনি। আরও এক বাড়ি কাজ সেরে এসেবেলা ১২টা নাগাদ শুরু হয় রান্না। কোনও মতে একটা তরকারি শেষ করেই আর এক বার ভাতটা চাপিয়ে দেন। ফুটলেই হাঁড়ি উপুড়! লক্ষ্মী বললেন, ‘‘গ্যাসের দাম হাজার টাকা। একটানা ভাত ফোটানো চলে? তবে, এখন আর গ্যাস নেই আমাদের। উনুনই ভরসা। গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করে দিয়েছি। কিন্তু ভাত রান্নার এই পুরনো অভ্যাস ছাড়িনি, জ্বালানি বাঁচে বলে!’’

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রকের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা প্রকাশ হওয়ার পরে শোরগোল পড়েছে এ নিয়ে। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উজ্জ্বলা যোজনা (গরিব পরিবারের মহিলাদের জন্য নিখরচায় রান্নার গ্যাসের সংযোগ) চালু করার সাত বছর পরেও গোটা দেশে গ্রামাঞ্চলের অর্ধেকেরও কম পরিবারে রান্নার গ্যাসে রান্না হচ্ছে। এ রাজ্যের অবস্থা আরও করুণ। এখানকার গ্রামের ৭৬ শতাংশ পরিবারেই রান্না হচ্ছে কাঠকুটো, ডালপালা বা খড়কুটো জ্বালিয়ে। শুধু জেলা বা প্রত্যন্ত গ্রামেই নয়, খাস কলকাতাতেও বহুজায়গায় চলছে উনুন জ্বালিয়ে রান্না। উত্তর থেকে দক্ষিণ, শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেল, অনেকেরই ভরসা কাঠকুটোর উনুন। কোথাও বাড়ি ভাঙা হলে ভ্যান ভাড়া করে বাতিল কাঠ নিয়ে আসেন পুরুষেরা। পুজোর শেষে মণ্ডপ থেকেওকাঠকুটো নিয়ে আসা হয়। যাঁরা খালপাড়ে বা পুকুরপাড়ে থাকেন, তাঁরা শুকনো ডাল কুড়োন, কখনও ডাল কেটেও আনেন। শুকিয়ে নিলে জ্বালানি হয়। কোথাও কোথাও আবার কারখানার ছাঁটের কাঠ বিক্রি হয় আট-দশ টাকা কেজি দরে!

নোনাডাঙার রাণু শিকদার যেমন জানালেন, নিজের হাতে লোহার বালতিতে তোলা উনুন তৈরি করেছেন এ বছর। আগে কেরোসিনে রান্না করতেন। কিন্তু যে হারে কেরোসিনের দাম বেড়েছে, তাতে সেই পথ বন্ধ। বাগবাজারের হাজার বস্তির কাছে একটি মাঠে দেখা গেল, পরপর উনুন তৈরি হয়েছে। তাতে বাঁশ, কাঠ গুঁজে রান্না চলছে ভরদুপুরে। কোথাও স্কুল থেকে ফেরাকিশোরী রান্না সারছে। কেউ আবার মাটির উনুন ধরিয়ে মেয়েকে বসিয়ে রেখে কাঠ আনতে গিয়েছেন। অনেকেই বস্তির পুরনো কাঠের ছাউনি থেকে কাঠ খুলে এনেছেন রান্না করবেন বলে। সেখানেই দেখা গেল, ধোঁয়ায় সারা ঘর কালি, চোখে জল, বাচ্চাদের কাশি। সমীক্ষা বলছে, কয়লা-কাঠের উনুনের দূষণ বছরে অন্তত আট লক্ষ অকালমৃত্যুর কারণ।

বক্ষরোগ চিকিৎসক ধীমান গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘কাঠকুটো, জঞ্জাল পোড়ালে রান্নার গ্যাসের চেয়ে অনেক বেশি ধোঁয়া হয়।আমাদের দেশের মহিলাদের, যাঁদের রান্নার জায়গাতেই অনেকটা সময় কাটে, তাঁদের মধ্যে থেকে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার অভিযোগ বেশি আসার কারণ রান্নার এই জ্বালানি। পুরুষদের ক্ষেত্রে যেমন সিগারেট, মহিলাদের ক্ষেত্রে তেমন এই জ্বালানি।’’ তাঁর দাবি, ‘‘মাঝে এই ব্যাপারটা কিছুটা কমেছিল। এখন রান্নারগ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আবার পুরনো, অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থা ফিরছে। বিশেষ করে শীতে, যখন বায়ু চলাচল কম থাকে, তখন ঘুঁটে, কয়লাবা কাঠের উনুন জ্বালালে তা নিশ্চিত ভাবেই শহরের হওয়াকে নিঃশ্বাস নেওয়ার পক্ষে আরও অযোগ্য করে তোলে।’’ তা ছাড়া, আগুন লাগার ভয়ও আছে।

উল্টোডাঙায় বাসন্তী কলোনির কাছে আবার দেখা গেল, রিনা মিদ্যার ঘর তৈরি হয়েছে কেবল টিন, কাঠ আর প্লাস্টিক চাদরে। কাঠেরআগুন হাওয়ায় এ দিক, ও দিক যেতে চায়। ঘরে দুই শিশুকন্যা। কোনও মতে তাঁদের নিয়েই রান্না চলে। তারই মধ্যে পালন করতে হয় স্বামীর হোটেলের দু’বেলার রান্নার ফরমায়েশ। একই অবস্থা পটারি রোডের বস্তিরবাসিন্দা ময়না বিশ্বাস, রাণু ঘোষদের। রাণুর ছেলে রতন বললেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী যে বছর ক্ষমতায় এলেন, সে বছর সরকার ২৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল কেরোসিনে। কমতে কমতে ২০২১-’২২ সালের বাজেটে তা শূন্য হয়ে গেল। ২০১৬ সালে উজ্জ্বলা প্রকল্প ঘোষণা হল।গ্যাসের সংযোগ পেলাম। কিন্তু, সিলিন্ডারের যা দাম দাঁড়াল, তাতে গ্যাসের সংযোগই অভিশাপ হয়ে উঠল। না পারছি ব্যবহার করতে, না পারছি ফেলে দিতে। তাইবাধ্য হয়েই উনুন বানিয়েছি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘মা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। ডাক্তার এই রান্না বন্ধ করতে বলছেন। কিন্তু, উপায় কী? রোগ সারাব, না কি পেট ভরাব?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE