Advertisement
E-Paper

কিলোমিটারে ভাড়া ১০০০! অ্যাম্বুল্যান্সের আকাল চলছেই

ট্র্যাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক পুলিশ আধিকারিক শুধু জানিয়েছেন, নজরদারি চালানো হচ্ছে।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৪৯
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের উপরে পড়ে রয়েছে অ্যাম্বুল্যান্স।

চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের উপরে পড়ে রয়েছে অ্যাম্বুল্যান্স। নিজস্ব চিত্র।

রেট কার্ড ১: আর জি কর থেকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ৫.৮ কিলোমিটার পথ যেতে কখনও ভাড়া হাঁকা হচ্ছে তিন হাজার, কখনও চার হাজার!

রেট কার্ড ২: পার্ক সার্কাস মোড় থেকে এসএসকেএম পর্যন্ত মাত্র ৩.৫ কিলোমিটার পথ অক্সিজেন ছাড়া যেতে ভাড়া আড়াই হাজার টাকা। আর লোক বুঝে অক্সিজেন-সহ সেটাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি!

রেট কার্ড ৩: এন আর এস হাসপাতাল থেকে রোগীকে নিয়ে রাস্তার উল্টো দিকের প্যাথোলজি সেন্টার পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য ভাড়া ২০০০ টাকা। শুধু পৌঁছে দিতে হলে ভাড়া দেড় হাজার! আর রোগী কোভিড আক্রান্ত হলে তো ভাড়ার কোনও ঠিক নেই।

এই মুহূর্তে শহর জুড়ে বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবার নামে এমনই ‘লুট’ চলছে বলে অভিযোগ। করোনার পরিস্থিতি যত ভয়ঙ্কর হচ্ছে, ততই যেন মাত্রাছাড়া হচ্ছে অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের একাংশের জুলুম। কখনও কোনও অ্যাম্বুল্যান্স চালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে করোনা রোগীকে ফেলে পালানোর, আবার কখনও টাকায় পোষাচ্ছে না বলে রোগীর অক্সিজেন মাস্ক খুলে নামিয়ে দেওয়ার। বহু ক্ষেত্রেই জরুরি সময়ে ডেকেও মিলছে না অ্যাম্বুল্যান্স।

গিরিশ পার্কের বাসিন্দা এক ভুক্তভোগীর কথায়, “আমার বাবার বয়স ৭২। গত বুধবার তাঁর করোনার রিপোর্ট পজ়িটিভ আসে। জ্বরে ভুগছিলেন তারও তিন-চার দিন আগে থেকে। রবিবার রাতে অবস্থা খারাপ হওয়ায় অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য ফোন করা শুরু করি। সরকারি হেল্পলাইন নম্বর বেজে গিয়েছে। পাড়ার ক্লাবও অ্যাম্বুল্যান্স দিতে পারেনি। এক পরিচিতের দেওয়া নম্বরে ফোন করলে শেষে এক অ্যাম্বুল্যান্স চালক বলেন, ‘মেডিক্যাল কলেজে নামিয়ে দিয়ে চলে আসব, আট হাজার টাকা লাগবে! দিনের বেলা হলে চার হাজারে হয়ে যেত’!” শেষে এক প্রতিবেশীর গাড়িতে কোনও মতে বৃদ্ধকে হাসপাতালে নিয়ে যান তাঁরা। পার্ক সার্কাসের বাসিন্দা স্বপন ঘোষ নামে এক ব্যক্তি আবার জানালেন, তাঁর বছর তেরোর ছেলে সংক্রমিত হয়েছিল। দিন সাতেক আগে হঠাৎ তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। অনেক খুঁজে একটি বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে প্রথমে এসএসকেএমে যান তাঁরা। সেখান থেকে মেডিক্যালে পাঠানো হয়। ওই পর্যন্ত পৌঁছে আর দাঁড়াতে পারবেন না বলে জানান অ্যাম্বুল্যান্সের চালক। তখনও শয্যা পাওয়া যায়নি। স্বপনবাবু বলেন, “চালক ওয়েটিং চার্জ লাগবে বলে চেঁচাতে শুরু করেন। ততক্ষণে দুই হাসপাতাল ঘোরার জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়েছে। আর টাকা নেই বলে আমি জরুরি বিভাগের ভিতরে খোঁজ করে এসে দেখি, অক্সিজেন মাস্ক খুলে ছেলেকে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামিয়ে দিয়েছে!’’

এমন অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। গত বছর করোনার বাড়বাড়ন্তের সময়েও টাকা মেটাতে না পারায় রোগীর কানের দুল খুলে নেওয়ার মতো ঘটনা যেমন সামনে এসেছিল, তেমনই সংক্রমিত রোগিণীকে অ্যাম্বুল্যান্সেই ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল এক চালকের বিরুদ্ধে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সে সময়ে কড়া অবস্থান নিয়েছিল দেশের শীর্ষ আদালত। হয়রানি রুখতে রাজ্যগুলিকে অ্যাম্বুল্যান্সের ভাড়া বেঁধে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। প্রতি জেলায় কোভিড রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত অ্যাম্বুল্যান্স নিশ্চিত করতে হবে রাজ্য সরকারকে, এ কথাও জানিয়েছিল বিচারপতি অশোক ভূষণের বেঞ্চ। কিন্তু তার পরেও বদলায়নি পরিস্থিতি।

কলকাতার পুর প্রশাসকেরা জানান, এই মুহূর্তে শহরে পুরসভার ১৪টি অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে। বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের সংখ্যা পাঁচশোরও বেশি। যে কেউ নতুন গাড়ি কিনে অ্যাম্বুল্যান্সের পারমিটের জন্য আবেদন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কর ছাড়ও পাওয়া যায়। বহু ক্লাবকে নানা সময়ে দেওয়া অনুদান থেকেও কিছু অ্যাম্বুল্যান্স কেনা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্লাবের অ্যাম্বুল্যান্সই তৃতীয় কোনও পক্ষকে ভাড়ায় দেওয়া থাকে, ফলে সেগুলির উপরে ক্লাবের কার্যত কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এক পুরকর্তার কথায়, “গত বছর কিছু ক্লাবের সঙ্গে বৈঠক করে শহরের মধ্যে হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল যাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বাধিক ৬০০ টাকা ভাড়া বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, অক্সিজেন লাগলে অতিরিক্ত ১০০ টাকা নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এখনও চলছে যেমন খুশি ভাড়া হাঁকা।”

রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের শীর্ষ কর্তার অবশ্য বক্তব্য, “আমাদের পক্ষে সবটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সের এই জুলুম পুলিশ এবং পরিবহণ দফতরের দেখার কথা। সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা নিশ্চিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি।”

লালবাজারের কোনও কর্তা অবশ্য এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাননি। ট্র্যাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার এক পুলিশ আধিকারিক শুধু জানিয়েছেন, নজরদারি চালানো হচ্ছে। ধরা পড়লেই অ্যাম্বুল্যান্সের রেজিস্ট্রেশন ও চালকের লাইসেন্স বাতিল হবে। কিন্তু সেই ভয়ে জুলুম কমবে কি? এই মুহূর্তের বাস্তব পরিস্থিতি অবশ্য অন্য কথাই বলছে।

Hospital Ambulance Covid Infection COVID-19
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy