Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

কাঠবাদাম, পেস্তা, মধুতে উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা

পেরিয়ে গিয়েছে পঁয়ষট্টি বছর। প্রতি নভেম্বরের শেষ থেকে মার্চের রবিবারে গোধূলি আকাশে এখনও চোখ রাখলেই দেখা যায়, ঝাঁক বেঁধে ওরা ফিরে আসছে ঠিকানায়। আসানসোল, গয়া, হাজারিবাগ, মোগলসরাই, কানপুর, ইলাহাবাদ বা দিল্লি থেকে।

যূথবদ্ধ: শীতের সকালে রোদে পিঠ পেতে রেসিং পায়রার দল। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

যূথবদ্ধ: শীতের সকালে রোদে পিঠ পেতে রেসিং পায়রার দল। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

জয়তী রাহা
শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:০০
Share: Save:

দুনিয়া জুড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক। বাদ নেই এ শহরও। এক মধ্যরাতে ঘর ছাড়া হল ওরা। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে আসা ব্রিটিশ সৈন্য কয়েক ঘর গৃহস্থের ঘুম ভাঙিয়ে খাঁচাবন্দি করে নিয়ে গেলেন একঝাঁক পায়রা। ভয়, জাতিতে ‘হোমার’ ওই রেসিং পায়রা পাঠিয়ে পাছে শত্রু শিবিরে গোপনবার্তা আদানপ্রদান হয়। শোনা যায়, ১৯৫০-’৫১ সাল নাগাদ মাত্র পাঁচ-ছ’টি হোমার পায়রা ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ফেরত পাওয়া গিয়েছিল।

পেরিয়ে গিয়েছে পঁয়ষট্টি বছর। প্রতি নভেম্বরের শেষ থেকে মার্চের রবিবারে গোধূলি আকাশে এখনও চোখ রাখলেই দেখা যায়, ঝাঁক বেঁধে ওরা ফিরে আসছে ঠিকানায়। আসানসোল, গয়া, হাজারিবাগ, মোগলসরাই, কানপুর, ইলাহাবাদ বা দিল্লি থেকে। এ ছাড়া প্রতি সকালের গা ঘামানো তো রয়েছেই। কারণ আজও নিয়মিত ওই সময়ে হোমার পায়রার মর্যাদা রক্ষার পরীক্ষায় আয়োজিত হয় রেস।

ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ফিরে পাওয়া হোমার পায়রা নিয়েই কলকাতায় প্রথম রেসিং পায়রার ক্লাব করেন এ শহরের চিনা নাগরিক পি এস লি। ১৯৫৩ সালে ৭৫ বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে তৈরি হয় ক্যালকাটা রেসিং পিজিয়ন ক্লাব (সিআরপিসি)। যদিও স্বাধীনতার আগে থেকেই রেসিং পিজিয়নদের নিয়ে একটি ক্লাব ছিল এ শহরে। নথি সংরক্ষণে অনিচ্ছুক বাঙালির স্মৃতি বলে, সম্ভবত সেটা ১৯২৫ সাল। আ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ব্রিটিশ, চিনা, রানি রাসমণির পরিবার-সহ এ শহরের কয়েকটি বনেদি পরিবার সদস্য ছিল সেই ক্যালকাটা রেসিং পিজিয়ন অ্যাসোসিয়েশন-এর। আশির দশকের মাঝে সিআরপিসি থেকে আরও একটি ক্লাব তৈরি হয়, নাম ক্যালকাটা রেসিং পিজিয়ন অর্গানাইজেশন (সিআরপিও)। এই দু’টি ক্লাব বাঁচিয়ে রেখেছে ঐতিহ্য।

শহরে পায়রা রেসে মজে আছে গোটা তিরিশেক পরিবার। সেখানে শৌখিন পায়রার ঐতিহ্য টিকে হাতে-গোনা পুরনো পরিবারেই। ১৯৩৫ সালের আশপাশ। কলেজ যাওয়ার আগে প্রাসাদবাড়ির ব্যালকনিতে রাখা শখের পায়রাগুলি উড়িয়ে দিতেন এক যুবক। তাঁর কলেজ থেকে ফেরার সময়টা কিন্তু কখনও ভুল করত না পায়রারা। বাবা মৃগেন্দ্র মল্লিকের এই পায়রা-শখ ছিল আমৃত্যু।
সঙ্গী ছিলেন দুই ভাই, হেমেন্দ্র ও পূর্ণেন্দ্র। সে বাড়িতে এখনও বিভিন্ন প্রজাতির দুষ্প্রাপ্য পায়রা এবং বর্মা সেগুনের রাজকীয় খাঁচা আছে। বছর কয়েক আগে সে সব দেখে তারিফ করে গেছেন বেনারসের মহারাজা— জানালেন মার্বেল প্যালেসের হীরেন্দ্র মল্লিক।

রেসিং পায়রা নিয়ে দীর্ঘদিন চর্চা করেছেন সিআরপিও-র অশীতিপর সদস্য সুরথ বন্দ্যোপাধ্যায়। নব্বইয়ের দশকের প্রথমে তাঁর দোর্দণ্ডপ্রতাপে থরহরি ছিলেন অন্যরা। একাধিক বিজয়ী তৈরি করা ‘ক্ষিদদা’ সুরথবাবুর গোপন টোটকা, প্রতি বর্ষার সক্কালে ছোট্ট ম্যাজিক বড়ি। তুলসীপাতা, কাঠবাদাম, পেস্তা, কিশমিশ বেটে মেশানো হত ছাতুর সঙ্গে। এই টোটকা জানতে চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে বিস্তর। তবু টলানো যায়নি সুরথবাবুকে, হাসতে হাসতে বললেন সিআরপিও-র সদস্য শুভঙ্কর মণ্ডল। আইআইটি-র প্রাক্তনী শুভঙ্করবাবুর কথায় উঠে এল পুরনো স্মৃতি, ‘‘নকশাল আমলে ছেলেদের ঘরে আটকে রাখতে বাবা বাড়িতে প্রথম পায়রা পোষেন। পরে সেটাই নেশা হয়ে গেল।’’

নেশার টানে বিজয়ী করার প্রস্তুতি শুরু হোমার পায়রার জন্মের আগেই। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পাত্র-পাত্রী নির্বাচন। ইংলিশ, বেলজিয়ান এবং জার্মান লাইনের হোমার অতি উচ্চ শ্রেণির। সেরকমই এক উদাহরণ ‘এফ টেন’। জীবনে তিনবার রেসে প্রথম হয়ে সে চ্যাম্পিয়ন হয় ২০০৮-এ। মায়ের দিক থেকে ফরেন কারেন্সি, বাবার তরফে ইংলিশ লাইন। স্নোবল শ্রেণিভুক্ত ‘এফ টেন’-এর ঠাকুমা দিল্লি-কলকাতা ১৬ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়েছিল। শুনে লজ্জা পাবেন রাজধানীর চালকও— বলছেন সিআরপিসি-র সদস্য সঞ্জয় দাস। একটি পায়রার জন্ম হতেই শুরু হয় পরের প্রজন্মের কাউন্টডাউন। তাই দশ দিন বয়সেই পায়ে পরিয়ে দেওয়া হয় ক্লাবের নাম, জন্মসন-সহ ঠিকুজি লেখা বিশেষ রিং। যা দেখে ঠিক হয় মেটিং টাইম।

আরেক জরুরি বিষয় উচ্চমানের রসদ। ভাতের মতোই ওদের প্রধান খাবার ছোলা। ‘সাইড ডিশে’ থাকে খোসা-ছাড়ানো যব, ভুট্টা, সয়াবিন। প্রতি বর্ষায় নতুন পালক গজায় ওদের। তখন দেওয়া হয় অল্প সর্ষে, তিসি, কুসুম দানা, সূর্যমুখীর বীজ। পরবর্তী রেসের জন্য চাঙ্গা করতে থাকে কাঠবাদাম, পেস্তা, মধু। সবটাই নির্দিষ্ট পরিমাণে। ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, বছরে দু’বার কৃমির ওষুধ থাকে তালিকায়। রেস থেকে ফেরা পায়রার পা ডেটল-জলে ধুইয়ে গ্লুকোজ-জল খাইয়ে রাখা হয় ঘণ্টা খানেক। প্রত্যেকের জন্য বছরে এই রাজকীয় আদরের খরচ পড়ে পাঁচ হাজার টাকা।

প্রতি বছর পায়রা রেসের আগে বন দফতর এবং পশুপালন দফতরের ছাড়পত্র নিতে হয়। সেই জটিলতায় কয়েক বার আটকেছে রেস। কনভেনারের তত্ত্বাবধানে ট্রেনে করে নির্দিষ্ট স্টেশনে পায়রা পাঠানোর খরচও রয়েছে। কিন্তু সরকারি সাহায্য না মেলায় কঠিন হচ্ছে লড়াই। নির্দিষ্ট স্টেশন থেকে এক জন সাক্ষীর সামনে সিল ভেঙে পায়রা উড়িয়ে সময়টা লিখে রাখা হয়। পথে কোনও বিপদ না হলে ওরা ঠিক ফিরে আসে আস্তানায়। তাই অংশগ্রহণকারীর বাড়ির ছাদে স্টপওয়াচ নিয়ে পৌঁছে যান বিচারক। বিজয়ীর জন্য বরাদ্দ হয় শংসাপত্র এবং কাপ। অর্থমূল্য দিয়ে নয়, প্রশাসনিক জটিলতা শিথিল করে পাশে থাকুক সরকার, তাতেই বেঁচে থাকবে এই ঐতিহ্য— এটুকুই আবেদন রেসিং পায়রার ক্ষিদদা’দের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pigeon Pigeon Racing
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE