Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্রত্যাশার পাথরেই যেন সব চাপা না পড়ে যায়

স্থান-কাল-পাত্র বদলে যায়। কিন্তু প্রত্যাশার পাথর সরে না। মা-বাবা বা শিক্ষকদের দাবি তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে যুক্ত হয় নিজের উপরেই নিজের বল্গাহীন প্রত্যাশা।

মর্মান্তিক: এসএসকেএমের মর্গে কৃত্তিকার দেহ নিয়ে পরিজনেরা। শনিবার। ছবি: সুমন বল্লভ

মর্মান্তিক: এসএসকেএমের মর্গে কৃত্তিকার দেহ নিয়ে পরিজনেরা। শনিবার। ছবি: সুমন বল্লভ

সম্রাট মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯ ০৩:১০
Share: Save:

‘তোমাকে এত ভয় পাই কেন? তা যদি বাখ্যা করে লিখতে যাই, তা হলে সেই ভয় আরও বেশি করে চেপে ধরে আমাকে...।’ মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগে বাবাকে পাঠানো এক দীর্ঘ চিঠিতে এ কথাই লিখেছিলেন সাহিত্যিক ফ্রান্জ় কাফকা। সেই বাবা, যাঁর ভয়ে সারাটা জীবন কাটিয়েছেন পাথর চাপা ঘাসের মতো। বাবার মনের মতো হতে পারেননি— এই হতাশা থেকে নিজের মনের মতোও কখনও হতে পারেননি ‘মেটামরফোসিস’-এর স্রষ্টা। নিজের অমিত প্রতিভার প্রতিও ছিল ঘোর অনাস্থা। মৃত্যুর আগে অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি বন্ধুর হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এগুলো না পড়ে পুড়িয়ে দিও’।

স্থান-কাল-পাত্র বদলে যায়। কিন্তু প্রত্যাশার পাথর সরে না। মা-বাবা বা শিক্ষকদের দাবি তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে যুক্ত হয় নিজের উপরেই নিজের বল্গাহীন প্রত্যাশা। যেখানে মাঝারিয়ানার কোনও ঠাঁই নেই। ব্যর্থতার কোনও সুযোগ নেই। সেই প্রত্যাশা পূরণ হলে ভাল। না হলেই হতাশা, অবসাদ এবং তা থেকে চরম খারাপ কোনও পরিণতি। কাফকা আত্মহত্যা করেননি। সকলে করেনও না। কিন্তু চোদ্দো বছরের স্কুলছাত্রী কৃত্তিকা পালের মৃত্যুর মতো কোনও কোনও ঘটনা আমাদের আবারও সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। অভিভাবকেরা কি বড্ড বেশি দাবি করে ফেলছেন সন্তানের কাছে? না হলে প্রতি বছর এত পড়ুয়ার আত্মহত্যা দেখতে হবে কেন?

কৃত্তিকার মৃত্যুর কারণ এখন আতসকাচের তলায়। তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু প্রশ্নটা পুরনো। এবং এই মুহূর্তে উত্তরটা খুঁজে পাওয়াও বোধহয় খুব জরুরি। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের মতে, এ দেশে জনসংখ্যা এবং প্রতিযোগিতার যা বহর, তাতে পড়াশোনায় সেরা হওয়ার চাপ থাকবেই। তা এড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু তার মধ্যেই বাবা-মায়েদের খেয়াল রাখতে হবে, সেই চাপ যাতে

মাত্রাছাড়া না হয়ে যায়। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়ির ‘হ্যাপিনেস ইনডেক্স’-টা যেন ঠিক থাকে। অর্থাৎ, পরিবারে একটা আনন্দের পরিবেশ বজায় রাখাটা খুব জরুরি। সব সময়ে সিরিয়াস আলোচনা না করে বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে লঘু কথাবার্তাও বলুন। তাতে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতে সুবিধা হবে।’’

পায়েল মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। আপনার সন্তান আজ যা নিয়ে পড়তে চাইছে, তা নিয়ে হয়তো আপনি খুশি। কিন্তু কাল যদি তার সেটা ভাল না লাগে এবং অন্য কিছু নিয়ে পড়তে চায়, তা হলে ভেঙে পড়বেন না। এই ভাললাগার পরিবর্তন কিন্তু খুব স্বাভাবিক।’’

বছর কয়েক আগে খবরের শিরোনামে এসেছিল অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুরের এক স্কুলের প্রিন্সিপালের লেখা একটি চিঠি। তাতে পরীক্ষা নিয়ে বাবা-মায়েদের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে তিনি লেখেন, ‘মনে রাখবেন, যারা পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের মধ্যে হয়তো ভবিষ্যতের এক জন শিল্পী আছে, যার অঙ্কটা তত ভাল না হলেও চলবে। হয়তো এক জন শিল্পপতি আছে, যার ইংরেজি বা ইতিহাসটা দুর্বল হলেও অসুবিধা নেই। হয়তো এক জন অ্যাথলিট আছে, যার ফিজিক্সে খামতি থাকলেও কিছু যাবে-আসবে না। আপনার সন্তান ভাল করলে ভাল। না করলে দয়া করে তার আত্মবিশ্বাসটা ছিনিয়ে নেবেন না।’

সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র মনে করেন, এই প্রত্যাশার চাপ যে কারণে তৈরি হচ্ছে, আগে সেখানে পরিবর্তন জরুরি। তিনি বলেন, ‘‘যে কোনও বড় পরীক্ষার ফল প্রকাশের পরে প্রথম বা দ্বিতীয়দের নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এত হইচই হয় কেন? এটা বন্ধ হওয়া দরকার। সকলেই যে প্রবল মেধাবী হবেন, এমন তো কোনও কথা নেই।’’

একই মত শিক্ষিকা দেবী করের। তিনিও মনে করেন, প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই মাতামাতিটা বন্ধ হওয়া দরকার। বরং তাঁদের নিয়ে আলোচনা হোক, যাঁরা অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েও ভাল ফল করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করেন, পরবর্তীকালে শুধু কি তাঁরাই জীবনে ভাল করেন? বাবা-মায়েদের বিষয়টা ভাবতে হবে। এমনটা চলতে পারে না।’’

তবু তো বছরের পর বছর এমনটা চলছে। হয়তো বা চলবেও। ভরসা শুধু স্রোতের বিপরীতে থাকা কিছু টুকরো ভাবনা, যা মনে পড়িয়ে দেয় জয় গোস্বামীর ‘টিউটোরিয়াল’ কবিতাটির শেষ ক’টি লাইন:

‘অপু বলেছে পড়াশোনা হয়নি একদম / বলেছে ও ব্যাক পাবে, ব্যাক পেলে ও বলেছে, বাড়িতে কোথায় / বাথরুম সাফ করার অ্যাসিড আছে ও জানে,/ হ্যাঁ বাপী হ্যাঁ, ও বলেছে,/ উঠে যাবে কাগজের প্রথম পাতায়’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Krttika Pal Parents Depression
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE