নন্দলালের দুই কন্যা গৌরী ও যমুনা। দুজনেই কলাভবনের ছাত্রী ছিলেন। নটীর পূজা ও চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করে তাঁরা স্মরণীয় হয়ে আছেন। গৌরী ছবিও আঁকতেন খুব ভাল। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর নটীর পূজা-র নৃত্যাভিনয় দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন তেমনই মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর আঁকা ‘পূজারিণী’ দেখে।... গৌরীর আলপনা আঁকার হাতটিও ভাল ছিল। সুকুমারী দেবীর পরে ছাত্রীদের মধ্যে তিনিই বোধহয় সবচেয়ে ভাল আলপনা দিতে পারতেন। নন্দলাল প্রবর্তিত অলংকরণকেন্দ্রিক শিক্ষা পরিকল্পনার অন্যতম অংশীদার ছিলেন গৌরী।” নন্দলাল বসুর জ্যেষ্ঠা কন্যা গৌরী ভঞ্জ (বসু) সম্পর্কে লিখেছেন চিত্রা দেব।
ছোটবেলা থেকেই শান্তিনিকেতনের শিল্পময়তায় বেড়ে ওঠা গৌরী কলাভবনে মগ্ন হন চারুকলা ও কারুশিল্পের চর্চায়। বাবার কাছেই মূলত তাঁর প্রাথমিক চিত্রশিক্ষা, পাশাপাশি সুকুমারী দেবীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এগিয়ে চলে কারুশিল্প শিক্ষা। রবীন্দ্রনাথের জীবনকালে শান্তিনিকেতনে নববর্ষ, রবীন্দ্র-জন্মোৎসব, হলকর্ষণ, বসন্তোৎসব-সহ নানা উৎসব-অনুষ্ঠানস্থলের অলঙ্করণে তাঁর কাজ প্রশংসা পেত। সুকুমারী দেবী অবসর নেওয়ার পর গৌরী কারুশিল্প বিভাগের দায়িত্ব নেন, তিন দশকেরও বেশি ছিলেন পরিচালনায়। আলপনা, সূচিকর্ম, বাটিক, চামড়ার কাজ-সহ কারুশিল্পের নানা ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা ছিল অসাধারণ; বিশেষত কলাভবনে বাটিক শিল্পের প্রচলন ও বিকাশে তাঁর বড় ভূমিকা। বাটিকের কৌশল ও পদ্ধতি বিষয়ে জানার উদ্দেশ্যে ডাচ ভাষায় লেখা একটি বইও অনুবাদ করেন, অমিয় চক্রবর্তীর স্ত্রী হৈমন্তী দেবীর সহায়তায়।
কলাভবনে শিক্ষক গৌরী ভঞ্জ শেখাতেন কারুশিল্প, নানা রকম হাতের কাজ। তাঁর শিল্পী-সত্তার বিশেষত্ব হল চারুশিল্প ও কারুশিল্পের মেলবন্ধন। শান্তিনিকেতনি ঐতিহ্যের ধারক তো তিনি ছিলেনই, তাকে আধুনিক রুচির সঙ্গে মেলানোর কাজটিও করেছেন অনায়াস দক্ষতায়। অজন্তার গুহাচিত্র থেকে প্রাণিত হয়ে সেই শিল্প-উপাদানকে রূপ দেন নিত্যব্যবহারের শাড়ির নকশায়।
উচ্চমার্গের শিল্প কী ভাবে সাধারণের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠতে পারে, গৌরী ভঞ্জের শিল্পকৃতি তারই অভিজ্ঞান। তাঁর নান্দনিক ভাবনা ও প্রয়োগের গভীর বীক্ষণ ও বিশ্লেষণ এ কালে তত হয়নি। সেই ভাবনা থেকেই হিন্দুস্তান পার্কের ‘আকার প্রকার’ আর্ট গ্যালারিতে দেবদত্ত গুপ্তের কিউরেশনে গত ১৯ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে প্রদর্শনী, ‘ক্রাফ্টিং ভিশনস: দি আর্ট অব গৌরী ভঞ্জ’। ১৬ অগস্ট পর্যন্ত, রবিবার ও সরকারি ছুটির দিন বাদে রোজ সকাল ১১টা থেকে সন্ধে ৭টা। আশা, বঙ্গীয় শিল্পকলার ইতিহাসে স্বল্প-আলোচিত এই শিল্পী পুনরাবিষ্কৃত হবেন। সঙ্গের ছবিগুলি গৌরী ভঞ্জের কৃতি, প্রদর্শনী থেকে।
দেড়শো বছরে
২৬ জুলাই, ১৮৭৬। আলবার্ট হল সভাঘরে একত্র হলেন আনন্দমোহন বসু শিবনাথ শাস্ত্রী নবগোপাল মিত্র উমেশচন্দ্র দত্ত দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতার বিশিষ্টজন। সেই সকালেই একমাত্র পুত্রের মৃত্যু সত্ত্বেও উপস্থিত ছিলেন সভার অন্যতম উদ্যোক্তা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সভা থেকেই স্থাপিত হয় ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ বা ‘ভারত সভা’। উদ্দেশ্য: দেশের অভ্যন্তরীণ জনমত শক্তিশালী করা, হিন্দু-মুসলমান সহ নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষকে এক রাজনৈতিক লক্ষ্যে একত্র করে সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনগুলিতে তাঁদের যুক্ত করা। শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। আজ দেড়শো বছর স্পর্শ করছে ‘ভারত সভা’, সেই উপলক্ষে দিনভর নানা অনুষ্ঠান। ৬২ বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটে আলোচনা দুপুর ৩টে থেকে: দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে ভারত সভার ভূমিকা নিয়ে অনুষ্ঠানে বলবেন প্রদীপ ভট্টাচার্য, জহর সরকার, মীরাতুন নাহার, অনিল কুমার রায়, প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগ প্রমুখ।
অরণ্য সপ্তাহে
“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?” কবির এ প্রশ্ন আজ নাগরিকেরও। পরিবেশের সঙ্গে যথেচ্ছাচারের দাম মানবসভ্যতাকে চোকাতে হচ্ছে; দরকার বনসৃজন ও পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি। এই উদ্দেশ্য নিয়েই পালিত হল ‘অরণ্য সপ্তাহ’, গত ১৪-২০ জুলাই। বন দফতরের সহযোগিতায় দক্ষিণ কলকাতার নাকতলা সেতু সাংস্কৃতিক সংস্থা আমলকী, অমলতাস, শিশু, মেহগিনি, জারুল, শিউলি, চন্দন, আতার চারা বিতরণ করল স্থানীয় স্কুলপড়ুয়া ও নাগরিকদের; গত ১৯ জুলাই সকালে, নাকতলা শক্তি সঙ্ঘে।
পূর্ণ প্রকাশ
কোনও গ্রন্থের প্রারম্ভিক ভাবনা ও তার পূর্ণ প্রকাশের মধ্যে ৬৫ বছরের ব্যবধান, বিস্ময়কর। ইতিহাসবিদ বিনয়ভূষণ চৌধুরীর চর্চার বিষয় আধুনিক বাংলার কৃষি ইতিহাস, গবেষণা কলকাতা ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, পড়িয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর বই দ্য হিডন স্ট্রিং: আগরারিয়ান ইকনমি অব কলোনিয়াল বেঙ্গল অ্যান্ড ইটস ইনস্টিটিউশনাল ফ্রেমওয়ার্ক (প্রাইমাস) প্রকাশ পাবে ১ অগস্ট দুপুর আড়াইটায়, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের শিবানন্দ হলে। গ্রন্থের বারোটি লেখার ভাবনা ও প্রথম প্রকাশ ষাটের দশকের গোড়া থেকে ১৯৮৫-র মধ্যে। ত্রিশ বছর পর আবার হয়েছে সংশোধন-সংযোজন, গত দশ বছরে গবেষণার আলোকে পুনঃ বিচার। গ্রন্থ প্রকাশ উপলক্ষে আলোচনা করবেন ইরফান হাবিব বিনয় চৌধুরী ডেভিড লাডেন শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় সুরঞ্জন দাস অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুপর্ণা গুপ্তু সংযুক্তা দাশগুপ্ত স্মৃতিকুমার সরকার জহর সরকার প্রমুখ।
আগ্রাসন নয়
ভারতে কৃষি, বাণিজ্য ও সামাজিক ক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির একচেটিয়া আগ্রাসন, জিন-পরিবর্তিত শস্যের অনুপ্রবেশ, মুনাফার জন্য প্রকৃতি ধ্বংস, প্রান্তিক মানুষের অধিকার হরণের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, চিকিৎসক, ছাত্রছাত্রী, শ্রমিক, কর্মচারী-সহ সাধারণ মানুষ ২০০৭-এ গড়ে তোলেন ‘একচেটিয়া আগ্রাসন বিরোধী মঞ্চ’ বা ‘ফোরাম এগেন্সট মোনোপলিস্টিক অ্যাগ্রেশন’। প্রতি বছর ২৬ জুলাই প্রতিষ্ঠাদিবসে হয় বার্ষিক আলোচনা। নানা বছরে বলেছেন বন্দনা শিবা নিবেদিতা মেনন পি সাইনাথ মাধব গ্যাডগিল প্রমুখ। এ বছরের আলোচনা আজ বিকেল সাড়ে ৪টায় মৌলালি রাজ্য যুব কেন্দ্রে। বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যুদ্ধের আবহে প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্কট নিয়ে বলবেন রাজেশ ভট্টাচার্য ও নাগরাজ আডভে।
সপ্রশ্ন
বিনয় জানতে চেয়েছিল, গোরার দেশ বলে কিছু আছে কি? গোরার উত্তর: দেশ বিরাজমান তার হৃদয়ে, মার্শম্যানের হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া-তে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘হিস্ট্রি’ আজ ‘ইতিহাস’-এর সমার্থক হলেও, ইতিহাস বলতে অথর্ববেদ থেকে ধারাবাহিক যে বিদ্যার কথা জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ তার পার্থক্য ও স্বকীয়তা সম্বন্ধে সচেতন, শাসকের পালাবদলের বাইরে সাবেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জটিল আখ্যান লিখেছিলেন বিবিধ দেশজ উপাদানে। প্রাচীনকাল নিয়ে সপ্রশ্ন রবীন্দ্রনাথ অতীতকে ছুঁয়ে-ছেনে বিচার করেছেন বার বার। রবীন্দ্রবীক্ষণে এই বর্ণময়, মানবতাবোধে দীপ্ত, প্রাচীন ইতিহাসের প্রেক্ষিত নিয়ে বলবেন রণবীর চক্রবর্তী, ২৭ জুলাই সন্ধে সাড়ে ৬টায়। ‘বারো পার্বণ’-এর আয়োজন, সন্তোষপুরে ‘বুক কেবিন’ বইঘরে।
মন্দির-মানচিত্র
শহর গড়ে ওঠার নানা পর্যায়ে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা হয়েছে নানা মন্দিরের। প্রতিষ্ঠাতার আর্থিক সঙ্গতি, কখনও বা যুগের চাহিদা নির্দিষ্ট করেছে তার আকার, স্থাপত্যরীতি, অলঙ্করণ। বাংলার চালা ও রত্ন-রীতির পাশাপাশি ছাপ ফেলেছে ইউরোপীয় শৈলী, নাটমন্দিরে শোভাবর্ধনে আয়োনিক বা করিন্থিয়ান স্তম্ভ। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা-ফলকের ভাষা ও বয়ানেও লুকিয়ে থেকেছে স্থানীয় প্রাচীন ইতিহাসের উপাদান। গঙ্গার মূল খাত পরিবর্তনের ফলে আদিগঙ্গার তীর বরাবর গড়ে ওঠা ছোট রাসবাড়ির (ছবি) মতো দেবালয়গুলি যেন সরে গেছে বিস্মৃতির অন্ধকারে, তাদের আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের নানা বাঁক বদলের গল্পও ভুলেছে শহর। আগামী ১ অগস্ট শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টায় কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)-র লাইব্রেরিতে ‘মন্দিরের মানচিত্র: রিডিং ক্যালকাটা থ্রু ইট’স ফরগটন শ্রাইনস’ আলোচনায় কিঞ্জল বসু মনে করিয়ে দেবেন কলকাতার প্রায়-বিস্মৃত কিন্তু এখনও সজীব সেই ঐতিহ্যধারা।
মাধব-কথা
“পড়ুয়া, অধ্যবসায়ী, অধ্যাপকবৃত্তিতে নিষ্ঠাব্রতী, প্রতিভাবান মানুষটির আত্মপ্রচারে বা থিয়েটারি ব্যবসায়ী-পনায় প্রবৃত্তি ছিল না।” হরিমাধব মুখোপাধ্যায় (ছবি) সম্পর্কে লিখেছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা থেকে দূরে, উত্তরবঙ্গের বালুরঘাট ছিল তাঁর নাট্যসাধনভূমি। ভাষিক-সাংস্কৃতিক স্থানিকতা কী করে থিয়েটারের ভাষা ও আঙ্গিকে জোগাতে পারে বিশ্বের প্রাণস্পন্দন, তাঁর হাত ধরে নানা নাট্যপ্রযোজনায় বুঝেছিল কলকাতা। এ বছর মার্চে প্রয়াত এই নাট্যকার, নির্দেশক ও সংগঠকের স্মরণে আগামী ৩০ জুলাই বিকেল ৫টায় তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে অনুষ্ঠান ‘মাধব-কথা’— ‘সাউথ কলকাতা শ্রাইন’ নাট্যগোষ্ঠীর উদ্যোগে। ওঁকে নিয়ে বলবেন বিশিষ্ট নাট্যজনেরা, অমিত ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় অভিনীত হবে নাটক চৌর্যগাথা, হরিমাধবের লেখা।
জলের রাজনীতি
নদী মানে না রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক সীমানা। নদীর জলে অধিকার কার, কোন দেশের? মনে পড়ে রবীন্দ্রনাটক মুক্তধারা: উত্তরকূট ও শিবতরাইয়ের মধ্যে জাতিঘৃণা রাজকুমার অভিজিৎ ভেঙে দিয়েছিলেন নিজের প্রাণের বিনিময়ে, বাঁধ ভেঙে। এই চিরকালীন গল্প ফিরে আসে বাস্তবেও, গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র সিন্ধুর জলবিভাজন নিয়ে। এতে নেই প্রাকৃতিক যুক্তি, আছে জাতি-ধর্মের হানাহানি, মানবতার লাঞ্ছনা; ভারত-পাক সীমান্ত-সংঘর্ষের আবহে সিন্ধুর জলপ্রবাহ রুদ্ধ করে ‘শত্রু’ দেশকে ‘শিক্ষা দেওয়া’র নীতিতে তারই প্রকাশ। অথচ ইউরোপে দানিয়ুব প্রবাহিত ছ’টি দেশের মধ্যে দিয়ে, সবাই তার আশিসধন্য। সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ফ্রেন্ডস অব ডেমোক্রেসি’ আগামী ১ অগস্ট বিকেল সাড়ে ৪টায় কলেজ স্কোয়ারে মহাবোধি সোসাইটি হল-এ আয়োজন করেছে আলোচনা, বলবেন কল্যাণ রুদ্র শিবাজীপ্রতিম বসু ভাস্কর গুপ্ত।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)