Advertisement
E-Paper

উজ্জ্বল কাপড়ের সারি! তবু ম্লান শহরের ধোবিখানা

১৫ অগস্ট, ১৯০২। দেশের স্বাধীনতার তারিখ থেকে আরও পঁয়তাল্লিশ বছর পিছনে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যাবে সেই তারিখে, নাগরিকদের কথা ভেবে যে দিন খুলেছিল এ শহরের বৃহত্তম উন্মুক্ত ধোবিখানা। 

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৪৪
শুদ্ধি: ধোয়া কাপড়ের সারি। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

শুদ্ধি: ধোয়া কাপড়ের সারি। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

১৫ অগস্ট, ১৯০২। দেশের স্বাধীনতার তারিখ থেকে আরও পঁয়তাল্লিশ বছর পিছনে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যাবে সেই তারিখে, নাগরিকদের কথা ভেবে যে দিন খুলেছিল এ শহরের বৃহত্তম উন্মুক্ত ধোবিখানা।

দক্ষিণের ম্যাডক্স স্কোয়ারের ঠিক উল্টো দিকে দু’ধারে ইটের নকশা করা পিলার। লোহার ফ্রেমে ফলকের মতো আটকানো রেলের কাঠের স্লিপার। আবছা সাদা রঙে ইংরেজিতে লেখা, সাউথ ধোবিখানা। পাশেই প্রতিষ্ঠার তারিখ। সদর পেরোতেই দু’ধারে থাকার কয়েকটি ঘুপচি ঘর। সেখান থেকেই নাকে আসে সাবানের গন্ধ। নজর আটকায় খোলা আকাশের নীচে শুকোতে দেওয়া কাপড়ের সারি।

প্রায় বাইশ বিঘা জায়গা জুড়ে এই ধোবিখানা। নম্বর লেখা ১৮০টি হজ অর্থাৎ কংক্রিটের বাঁধন। প্রত্যেকটির নীচে আছে জল ধরার জন্য চৌবাচ্চা। ভোর চারটে থেকে শুরু হয় কাপড় ধোলাই। কাজ শেষ হতে গড়িয়ে যায় সন্ধ্যা। ১৮০টি হজের দাবিদার ২৪৫ জন ধোবি। যাঁদের বেশির ভাগ বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন। এ ছাড়াও রয়েছেন কয়েক জন শ্রমিক। এঁরা মূলত বিহারের বাসিন্দা। ধোবিরা সপরিবার থাকেন চত্বরের বাইরে— ভবানীপুর, মুদিয়ালি, হাজরা এলাকায়।

প্রতিটি হজের একটি করে ভাটি থাকে। যেখানে গরম জলে তেলচিটে কাপড় ফোটানো হয়। তবে ব্রিটিশরা এই ভাটিগুলি করেছিল অন্য ভাবনা থেকে। অটোক্লেভ মেশিনের কাজ করত এই ভাটি। কী ভাবে? উনুনে লোহার কড়াইয়ে জল বসিয়ে দেওয়া হত। তার উপরে লোহার ট্রেতে রেখে দেওয়া হত থরে থরে ধোয়া কাপড়। জলীয় বাষ্প থেকেই কাপড় জীবাণুমুক্ত হত। বারো ঘণ্টা ধরে চলত সেই প্রক্রিয়া। সেই ভাটির অনেকগুলিই এখন ভেঙে গিয়েছে। তা ছাড়া চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে জীবাণুনাশের সেই প্রক্রিয়া।

শুরু থেকেই ন’টি কলের মাধ্যমে টালার জল আসে এই ধোবিখানায়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা ছড়িয়ে যায় হজে। ধোবি দীপক দাস, বাবলু দাস এবং সন্টু চৌধুরীরা জানাচ্ছেন, আগে জল চার বার আসত। এখন সকালে ৭টা-৯টা এবং বিকেলে ৪টে-৬টা পর্যন্ত জল আসে। জলের অভাবে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে ব্যবসার। এক সময়ে শহরবাসীর প্রয়োজন ভেবে হয়েছিল ধোবিখানা। বিভিন্ন সরকারি দফতরের পোশাকও ধোলাই হত এখানে। এখন নাগরিক, গুটিকয়েক হোটেল, রেস্তরাঁ, সালঁ, ক্লাব এই ধোবিখানার ধরা খরিদ্দার।

বিশাল এই কর্মযজ্ঞ চলে কয়েক ধাপে। প্রথমে ধোবিরা সংগ্রহ করে আনেন কাপড়। এর পরে ময়লা অনুযায়ী বাছাই করে ধোলাই শুরু হয়। শেষে পরিষ্কার জলে ধুয়ে স্টিলের ড্রামে কাপড় ফেলে হাতল ঘুরিয়ে তা নিংড়ে নেওয়া হয়। তাতে কাপড় দ্রুত শুকোয়। এর পরে পাট বা ইস্ত্রি করা কাপড় অর্ডার মতো পৌঁছে দেওয়া হয়। দিলীপ বলছিলেন, সাইকেল, টানা রিকশা, মোটরবাইক বা গাড়িতে করে ধোবিরা কাপড় সংগ্রহ এবং পৌঁছনোর কাজটা করেন। পাড়ার ধোবিওয়ালাদের থেকে অর্ধেক দামে মেলে এই পরিষেবা। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় শহরের সর্বত্র ওঁরা পৌঁছতে পারেননি।

প্রতিটি হজের জন্য পুরসভাকে ওঁরা মাসে দেন ২০০-২৫০ টাকা। শ্রমিক পিছু ৫০ টাকা। কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের অধীন এটি। দফতরের এক কর্তা বলেন, সাউথ ধোবিখানা থেকে পুরসভার আয় হয় না, একে খরচের খাতা বলা যেতে পারে। আপাতত এ নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নেই। পুরসভার পুরনো নথি বলছে, প্রথম থেকেই এই ধোবিখানা আয়ের উৎস ছিল না। জরুরি পরিষেবা হিসেবেই দেখা হত।

তৎকালীন আইএএস এস ডব্লিউ গুড তাঁর ‛মিউনিসিপাল ক্যালকাটা: ইটস ইনস্টিটিউশনস ইন দেয়ার অরিজিন অ্যান্ড গ্রোথ’ বইয়ে তুলে ধরেছেন সেই কলকাতার বিভিন্ন তথ্য। তাতেই রয়েছে, ১৮৮৯ সালে নাগরিকদের জন্য একটি ধোবিখানা তৈরির প্রস্তাব তোলেন পুরসভার চেয়ারম্যান। ১৮৮০ সালে তৎকালীন বোম্বেতে তৈরি বৃহত্তম ধোবিঘাটের কথা মাথায় রেখে সেই প্রস্তাব। ১৮৯০ সালে পুরসভার ঋণ তহবিল থেকে তা অনুমোদন করা হয়। বিভিন্ন কারণে তা তৈরি হতে পেরিয়ে যায় সময়। ১৯১৬ সালের ওই তথ্যে গুড উল্লেখ করছেন, শহর পরিকল্পনার সফল উদ্যোগ সাউথ ধোবিখানা। ১৯১৩-১৪ সালেও গড়ে ১৬৭টি হজ ব্যস্ত থাকত। প্রতিটির মাসিক ভাড়া ছিল দু’টাকা। শ্রমিক পিছু নির্ধারিত ছিল এক টাকা। ১৯১৩-১৪ সালে সাউথ ধোবিখানা থেকে পুরসভা বছরে পেত ৬,০৬৮ টাকা। বাৎসরিক ঘাটতি দশ হাজার টাকারও বেশি। সেখানে উল্লেখও রয়েছে― সস্তায় নাগরিক পরিষেবা মেলায়, এই ক্ষতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি।

এই নিয়েই মন খারাপ ওঁদের। যে পরিষেবা নিয়ে এতটা উদার ছিল পুরসভা, আজ ঠিক ততটাই উদাসীন। যার ফল, পরিকাঠামো আধুনিকীকরণের ভাবনা নেই পুরসভার। তাঁদের মতে, সরকারি সাহায্য পেলে আরও প্রসারিত হতে পারত এই পরিষেবা।

শতাব্দীপ্রাচীন ধোবিখানার ঐতিহ্য আর কত দিন! জানেন না ওঁরা। কারণ, মুখ ঘোরাচ্ছেন নয়া প্রজন্ম।

Dhobi Ghat KOlkata
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy