Advertisement
E-Paper

বাধা আসে যার জন্ম নিয়েই, শ্রদ্ধায় তার স্থান কোথায়

বছর দুই আগের কথা হবে। নেট দুনিয়ায় ঘুরপাক খেয়েছিল ছবিটি। গঙ্গার ধারে তর্পণের জন্য জড়ো হয়েছিলেন কানপুরের কয়েক জন মহিলা। জল দিচ্ছিলেন সেই কন্যাদের, যারা এই মায়েদের গর্ভ থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর আলোটুকুও দেখার অধিকার পায়নি। 

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৮ ০১:১৮
ফাইল চিত্র

ফাইল চিত্র

বছর দুই আগের কথা হবে। নেট দুনিয়ায় ঘুরপাক খেয়েছিল ছবিটি। গঙ্গার ধারে তর্পণের জন্য জড়ো হয়েছিলেন কানপুরের কয়েক জন মহিলা। জল দিচ্ছিলেন সেই কন্যাদের, যারা এই মায়েদের গর্ভ থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর আলোটুকুও দেখার অধিকার পায়নি।

তর্পণে মহিলাদের দেখা পাওয়া এই প্রথম নয়। তবে যে ভাবে ছবিটি ঘুরেছিল এক ফোন থেকে অন্য ফোনে, নিন্দা এবং প্রশংসা কুড়িয়ে, তা-ই বুঝিয়ে দিয়েছিল ঘটনাটি বিরল। গত কয়েক বছরে অপ্রচলিত এই উদ্যোগে শামিল হতে দেখা গিয়েছে বহু অঞ্চলের মেয়েদের। এ শহরের আনাচ-কানাচেও ধরা পড়েছে তেমন কিছু দৃশ্য। তবু মহালয়ার ভোরে পুরুষদের ভিড়ের মাঝ থেকে ভিজে কাপড়ে কোনও মাঝবয়সী মহিলার একা উঠে আসার দৃশ্য অকল্পনীয় না হলেও অপ্রচলিত তো বটে। কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে তর্পণের সম্পর্ক প্রচলিত নয় কেন, ভাবলেই ফিরে আসে সেই ছবি। যে দেশে বহু মেয়ের জন্মানোর অধিকারই জোটে না, সেখানে আবার তর্পণ!

শব্দটি শুনেছিলাম ঠাকুরদার মৃত্যুর পরে। তাঁর স্মৃতিতে অনেকের লেখা জড়ো করে তৈরি হয়েছিল বই। পরম যত্নে নাম দেওয়া হয়েছিল ‘তর্পণ’। জানা গিয়েছিল, প্রচলিত বাংলায় এ শব্দ ব্যবহার হয় শ্রদ্ধা জানানোর অর্থেও। সে দিন যেটা জানানো হয়নি, তা হল শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও লিঙ্গের ভেদাভেদ থাকে! পরে সামাজিক নিয়মে বড় হওয়ার ফাঁকে শিখে গিয়েছি, মহালয়ার সকালে পূর্বপুরুষের উদ্দেশে পরিবারের ছেলেরা জল দান করেন। পিতৃপক্ষের অবসানের সময়ে এই পার্বণী শ্রাদ্ধ বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শাস্ত্রমতেই সম্পন্ন করতে হয় সেই আচার। তবে এতে মা, মেয়ে, বাড়ির বৌয়ের যে বিশেষ স্থান নেই এবং তাঁদের জায়গা দেওয়া বা না দেওয়া যে নিতান্তই রাজনৈতিক, তা ফিরে এল ওই ছবির দৌলতে।

যে সন্তানদের জন্মাতেই দিলেন না, তাদের জন্য হঠাৎ তর্পণে গেলেন কেন মা? শোনা গিয়েছিল কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধেই ছিল এই পদক্ষেপ। ‘বেটি বাঁচাও’ প্রচারের অঙ্গ। তাই জন্ম না দিতে পারা কন্যাদের যখন এক দিন স্মরণ করার অধিকার পেয়েছিলেন অভাগিনী মায়েরা, সেই সময়েও গঙ্গাপাড়ে তাঁদের আশপাশে উপস্থিত ছিলেন সমাজ ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ মানুষজন। তবে সে দিনের তর্পণও কি ছিল সমাজের চোখ রাঙানির আর একটি পিঠ? মেয়ে, মায়েরা থেকেই গিয়েছেন সমাজনীতির বোড়ে হয়ে?

তার মানে সমাজ চাইলে মানতে এবং আনতে পারে সব পরিবর্তন? এমনকি বদলাতে পারে শাস্ত্রও? কারণ, শাস্ত্রে কোথাও মেয়েদের একা তর্পণ করার অধিকারই দেওয়া নেই বলে জানিয়েছেন প্রবীণ পণ্ডিত শম্ভুনাথ স্মৃতি ও বেদতীর্থ। তিনি বলছেন, ‘‘কোনও বিবাহিতা মহিলা স্বামীর তর্পণের সঙ্গী হতে পারেন মাত্র। এর বাইরে মেয়েদের তর্পণের কথা কোথাও উল্লেখ নেই। যাঁরা করেন, তাঁরা নিয়ম না মেনে করেন।’’ তবে ধর্মশাস্ত্র সংখ্যায় অনেক। সব শাস্ত্রেই কি একই নিয়ম? প্রবীণ পণ্ডিত মনে করান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনুস্মৃতিতে বলা নিয়মানুসারেই চলা হয়।

তবে কি শাস্ত্রের বিধি ভেঙেই মেয়েরা তর্পণে যোগ দেন আজকাল? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক দেবার্চনা সরকারের সঙ্গে কথা বলে যেন খুলতে থাকে ভাবনার জট। তিনি বলছিলেন, ‘‘শাস্ত্র তৈরি হয়েছে কাল ও স্থানের প্রয়োজনের নিরিখে।’’ প্রয়োজন যেমন অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক, সামাজিক হয়, তেমনই রাজনৈতিকও হয়। সে কথা মনে করান শ্রী চৈতন্য কলেজের সংস্কৃত বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক সোমা গুহরায়ও। তিনি বলেন, ‘‘বৈদিক যুগে মেয়েদের উপরে এত কড়াকড়ি ছিল না। তা ছাড়া, মহাভারতেও মেয়েদের তর্পণের নিদর্শন আছে। স্মৃতি যুগ থেকেই ধীরে ধীরে বদলেছে মেয়েদের প্রতি সামাজিক আচরণ।’’ মহাভারতে স্ত্রী পর্বে কৌরব রমণীদের তর্পণ করার বিশেষ উল্লেখ আছে। পরে শাস্ত্র যত কড়া হয়েছে, সে সঙ্গেই মেয়েরা একে একে সামাজিক অধিকার হারিয়েছে। প্রিয়জনেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ইচ্ছেটুকুও হয়ে দাঁড়িয়েছে বিতর্কের বিষয়। পুরাণ-গবেষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি অবশ্য এই বিতর্ক মানেন না। তিনি বলেন, ‘‘কোথাও লেখা নেই যে মেয়েরা তর্পণ করতে পারবে না। শ্রাদ্ধে যেমন শ্রদ্ধা জানানো হয়, তর্পণও তা-ই। মেয়েরা শ্রাদ্ধ করতে পারলে তর্পণ করবে না কেন?’’ তাঁর বক্তব্য, শাস্ত্রের নামে যখন-তখন নিয়ম ভাঙা আর গড়া হচ্ছে।

সেই ভাঙা গড়ার মাঝে এখনও প্রাসঙ্গিক থেকে যায় মেয়েদের এই সামান্য অধিকারের কথাও। এখনও কন্যাভ্রূণ হত্যা রোখার নামে চলে রাজনীতি। এখনও মেয়েরা আত্মীয়দের স্মরণ করতে গেলে পড়েন

সামাজিক রোষের মুখে। তবু সেই তর্পণের মহালয়া পেরিয়ে দেবীপক্ষ আসে। স্ত্রী শক্তির আরাধনা ঘিরে চলে বাণিজ্য, রাজনীতি, সমাজনীতির নানা গিমিক। তবু অশুভকে ভুলে উৎসবে মাতি মেয়েরাও!

Mahalaya Durga Puja Durga Puja 2018 Woman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy