স্মৃতিছায়া: এই সেই বাড়ি।
এ শহরের তিন কালের সাক্ষী আম বা অশ্বত্থ গাছটা রয়েছে এখনও। তবে তাদের পায়ের কাছে ছুটে বেড়ানোর জায়গাটা অনেকই কমে গিয়েছে।
মাস দুই আগে আট নম্বর থিয়েটার রোড (এখন শেক্সপিয়ার সরণি)-এর সুদৃশ্য পুরনো বাড়িটার উঠোনে ঘুরতে ঘুরতে ভাবছিলেন সাগর লোহানি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও তার কলকাতা-যোগ নিয়ে তথ্যচিত্রের কাজে এ শহরে এসে কিছুটা আবেগমথিত ঢাকাইয়া সাংবাদিক। ‘‘বোধহয় ওই গাছটার নীচেই আমি ও আমার ছোট বোন, বন্যা-উর্মিরা খেলতাম!’’— বলছিলেন মধ্য পঞ্চাশের প্রৌঢ়, আবার ন’বছরের এক বালকও তখন তিনি।
একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোয় বাবা কামাল লোহানির পিছু পিছু এ শহরে আশ্রয় নিয়েছেন ছোট্ট সাগররা সকলেই। যখন আক্ষরিক অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের ‘ব্যাকস্টেজ’ হয়ে উঠেছে কলকাতা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে নিয়ে যেতে বা সমান্তরাল ভাবে কূটনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ঘুঁটি সাজাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি সে-দিন থিয়েটার রোডের বাড়িটাই। আজকের কলকাতা যাকে ‘অরবিন্দ ভবন’ বলে চেনে।
বাড়ির পিছনে আম-অশ্বত্থের বেদীর কাছে রয়েছে উপাসনাস্থল। শ্রী অরবিন্দের পার্থিব অস্থি সংরক্ষিত সেই বেদীতে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয় ফাঁকা ছিল ওই চত্বর। হয়ত ওই তল্লাট, কিংবা পাশের মাঠটাতেই একাত্তরের এক বিকালে সূদূর কাশ্মীর থেকে পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মাইনসঙ্কুল পথ পার হয়ে হাজির হয়েছিল বাঙালি সেনাদের একটি পল্টন। থিয়েটার রোডের বাড়ির মাঠটাতেই তাঁবু গেড়েছিলেন তাঁরা। মুক্তিকামী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার তথা মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের কাছে সেই সৈনিকদের আর্জি—আমাদের অনুমতি দিন, এখনই পুব বাংলায় যুদ্ধে যোগ দিতে যাব!
অরবিন্দের উদ্দেশে দেশবন্ধুর ফলক-সহ ঘরটি।
একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেই করাচির জেলে বন্দি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এর পরেই ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার কাছে মেহেরপুরে শপথ নেয় ভাবীকালের বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভা। এর ক’দিনের মধ্যে সেই দেশছাড়া সরকারের প্রবাসের রাজধানী হয়ে ওঠে কলকাতা। থিয়েটার রোডের এই বাড়ি ছিল মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী ক্যাম্প।
ইতিহাসের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব অদ্ভূত মিলে গিয়েছে এই বিন্দুতে। অরবিন্দ-ভক্ত সুভাষ সরকার, তপন মণ্ডলেরা বলছিলেন, ১৮৭২-এ এখানেই জন্ম হয় শ্রী অরবিন্দের। এ হল তাঁর পিতৃবন্ধু মনমোহন ঘোষের বাড়ি। অরবিন্দের শতবর্ষের আগে অবশ্য স্মৃতিসংরক্ষণের তোড়জোড় ছিল না। আবার মুক্তিযুদ্ধের রুদ্ধশ্বাস ইতিহাসের সাক্ষীও এই বাড়ি।
মুজিবনগর সরকারের অধীনে ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে’ সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন, সাগরের বাবা কামাল লোহানি। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে বেতারকেন্দ্রের কাজ চললেও তাদের দিশা দেখাত থিয়েটার রোডের ক্যাম্প অফিস। সাগরের আবছা মনে আছে, সোফা-ঘেরা সেন্টার টেবিল সাজানো একটি ঘরে বসতেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেব। প্রধানমন্ত্রীর থাকার ঘর ও অফিস ছাড়াও মুজিবনগরের অস্থায়ী সচিবালয়, সেনাপ্রধান, বিমানবাহিনীর গ্রুপ-ক্যাপ্টেন বা পুলিশের আইজি-র অফিস— সব এ বাড়িতেই তখন। এখানেই মেসে দু’বেলা খেতেন প্রধানমন্ত্রীও। কিন্তু সে সব কোনখানে তা এখন ঠাহর করা মুশকিল।
১৬ ডিসেম্বরের ‘বিজয়-দিবস’-এ পাক জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণে হাজির থাকতেও এ বাড়ি থেকেই হেলিকপ্টারে ঢাকায় গিয়েছিলেন বিমানবাহিনী প্রধান গ্রুপ-ক্যাপ্টেন খন্দকর। প্রতি ১৭ এপ্রিল, অরবিন্দ ভবন প্রেক্ষাগৃহে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণের দিনটি পালন করে বাংলাদেশ সরকার। ইতিহাসের ঘ্রাণ নিতে মাঝেমধ্যেই হাজির হন খ্যাত-অখ্যাত বহু বাংলাদেশ অনুরাগী।
বাড়িতে ঢোকার মুখেই ফ্রেমবন্দি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের উদ্ধৃতি: দেশাত্মবোধের কবি, জাতীয়তাবাদের দ্রষ্টা ও মানবতাবোধের প্রেমিক অরবিন্দের কথা। তাঁর জন্মের ১০০ বছর বাদে বাঙালির আরও এক অপরাজেয় সংগ্রামের ইতিহাস এ বাড়িতে মিশে যাওয়া যেন এক আশ্চর্য সমাপতন!
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy