Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রতাপাদিত্য রোড

তরুণ প্রজন্ম বাইরে, পাড়াটা যেন বৃদ্ধাশ্রম

ভোর হতেই কয়েকটা চড়ুই-শালিক জানলার কাচে টোকা দিয়ে জানান দেয় আকাশে নতুন সূর্য উঠেছে। বারান্দায় এসে দেখি একটু একটু স্পষ্ট হচ্ছে পাড়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের পরিচিত ছবিটা।

বনশ্রী সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৬ ০১:০০
Share: Save:

ভোর হতেই কয়েকটা চড়ুই-শালিক জানলার কাচে টোকা দিয়ে জানান দেয় আকাশে নতুন সূর্য উঠেছে। বারান্দায় এসে দেখি একটু একটু স্পষ্ট হচ্ছে পাড়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের পরিচিত ছবিটা। সেই সময় চারদিকে পাখির কূজন আর সবুজ গাছগাছালিতে ভরা পাড়াটাকে নতুন করে উপলব্ধি করি। আর সেই উপলব্ধির ছোঁয়ায় এ পাড়াটা এক সুখের স্বর্গ।

রাসবিহারী অ্যাভিনিউ থেকে শুরু হওয়া প্রতাপাদিত্য রোড শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোডে গিয়ে মিশেছে। পাড়ার শাখা-প্রশাখার মধ্যে রয়েছে রানি ভবানী রোড, শ্রীমোহন লেন, ভবানন্দ রোড ইত্যাদি। আজকের পাড়াটা পরিচ্ছন্ন ঝাঁ-চকচকে। অসংখ্য বহুতলের ভিড়ে আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সেকেলে কিছু বাড়ি। ঠিক যেন অতীত আর বর্তমানের মাঝে এক সেতুর মতো। প্রথম যখন এ পাড়ায় এসেছিলাম তখন বাড়ির সংখ্যাই ছিল বেশি। এখন বেশির ভাগই বহুতল। এসেছেন কত নতুন মানুষ।

এ পাড়ার সকালের ছবিটা বেশ মনোরম। প্রতি দিন প্রাতর্ভ্রমণ সেরে কিছু মানুষ কাছেপিঠের চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে পরিচিতদের সঙ্গে আড্ডায় মাতেন। কিছুটা পরে দেখা মেলে কচিকাঁচাদের হাত ধরে স্কুল বাসের জন্য অপেক্ষারত অভিভাবকদের। তারই মাঝে ব্যস্ত অফিসবাবুরা গিন্নির ফরমায়েশ মেটাতে আপন মনে ফর্দ আওড়াতে আওড়াতে থলি হাতে বাজারের দিকে এগিয়ে চলেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে যানবাহনের হর্নের শব্দ। আর মাঝে মাঝে পথচলতি মানুষের কোলাহল। বিশেষ করে এই শ্রাবণ মাসে ‘ভোলে বাবা পার করেগা’ ধ্বনি মাঝে মধ্যেই কানে ‌আসে। আর আছে এক এক ধরনের ফেরিওয়ালার ডাক। কিছু কিছু ডাক তো এ পাড়ায় এসে থেকে শুনছি।

এলাকার কাউন্সিলর মালা রায়ের উদ্যোগে পাড়া এবং তার আশপাশ ঝাঁ চকচকে পরিচ্ছন্ন থাকে। এ কথা ঠিক আগের চেয়ে এলাকার মানুষের নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাড়া পরিচ্ছন্ন রাখার উদ্যোগ সফল হয়েছে। নিয়ম করে সকাল-বিকেল রাস্তা পরিষ্কার করা হয়। মাঝে মাঝে ছড়ানো হয়

ব্লিচিং এবং মশার তেল। জোরালো আলোয় এখন পাড়াটা রাতেও উজ্জ্বল থাকে। আগের চেয়ে গাছ-গাছালির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানে নানা প্রজাতির পাখির আনাগোনা লেগেই থাকে। ফুটপাথেও কিছু জায়গায় গাছ লাগানো হয়েছে। পুরসভার উদ্যোগে নিয়মিত গাছে জল দেওয়া হয়। কাছাকাছির মধ্যে বেশ কিছু ক্লাব আছে। তাদের উদ্যোগে হয় ছোটদের জন্য বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, স্বাস্থ্য শিবির ইত্যাদি।

পড়শির সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতার কারণে এখানে কখনও একাকীত্ব বোধ করি না। রাস্তায় বেরলেই পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলে আজও দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলার অভ্যাসটা আছে। প্রয়োজনে এক ডাকে সকলকে পাশে পাওয়া যায়। একে অপরের বাড়িতে যাতায়াতের পাশাপাশি আজও ভালমন্দ কিছু রান্না করলে সেটা প্রতিবেশীদের বাড়িতে পাঠানোর রেওয়াজটা টিকে আছে। আমার স্বামী যখন প্রয়াত হন, সেই সময় আমাদের আবাসনের এবং আশপাশের পড়শিরা কী ভাবে সাহায্য করিয়েছিলেন তা কখনও ভুলতে পারব না। এক বার আমি অসুস্থ হওয়ায় আমারই এক প্রতিবেশী আমায় নিয়ে গিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি করেছিলেন। আশপাশে যখন শুধুই সম্পর্কের অবক্ষয়ের কথা শুনি তখন মনে মনে গর্ব বোধ করি আমার প্রতিবেশীদের নিয়ে।

দেখতে দেখতে চোদ্দোটা বছর এ পাড়ায় কাটিয়ে দিলাম। আজও মনে পড়ে পাড়ার সেই দুষ্টু ছেলেগুলোর কথা। এক সময় যাঁরা খেলার ছলে কতই দৌরাত্ম্য করত। কবেই তারা বড় হয়ে বিভিন্ন পেশায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে কমেছে পাড়ার খেলাধুলোর পরিবেশও। এর কারণ ছোটদের বিকেলটা এখন কোচিং-এর ফাঁদে আটকে গিয়েছে। তা ছাড়া মাঠে গিয়ে খেলার অভ্যাসটাও কমেছে। পরিবর্তে এখন ছোটরা ডেস্কটপেই ক্রিকেট ফুটবল খেলতে পছন্দ করে। আগে পাড়ার রাস্তায় ছোটদের নিয়মিত খেলতে দেখা যেত। যানবাহনের দাপটে সেই দৃশ্য কবেই হারিয়েছে।

সময়ের অভাবে ক্ষীণ হয়ে এসেছে পাড়ার আড্ডাও। আগে কয়েকটি বাড়ির রকে কিছু মানুষকে আড্ডা দিতে দেখা যেত। সময়ের সঙ্গে সে দৃশ্যও বিরল হয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান সেরে যখন গভীর রাতে বাড়ি ফিরি তখন দেখি পাড়ার কিছু ছেলে আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে কিংবা পাড়ার মোড়ে বসে আড্ডা দেয়।

এখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত যত বাড়ে পাড়ার রাস্তাঘাটও ফাঁকা হয়ে যায়। কারণ বাঙালির সন্ধ্যাটা এখন টিভি সিরিয়াল আর রিয়্যালিটি শো-এর মায়াবী আকর্ষণে বুঁদ হয়ে আছে। তেমনই এক এক সময় মনে হয় পাড়াটা ক্রমেই একটা বৃহৎ বৃদ্ধাশ্রম হয়ে উঠছে। যুব সম্প্রদায়ের অনেকেই কর্মসূত্রে রাজ্যের বাইরে কিংবা বিদেশে থিতু। তাঁদের নিঃসঙ্গ অভিভাবকরা সন্তানের ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গোনেন। কাছাকাছি থাকতেন অভিনেতা অসিতবরণ, সঙ্গীতশিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। আজ তাঁরা শুধুই স্মৃতি।

এমন পাড়া আর কোথায় পাব খুঁজে, যেখানে প্রতিবেশীদের মধ্যে রয়েছে অন্তরের টান আর মনের মিল। এখানেই তো আছে জীবনের আনন্দ।

লেখক প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী
ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Banashree Sengupta Pratapaditya road
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE