Advertisement
E-Paper

বাংলায় ঢুকেই ভোলবদল বিশ্বকর্মার

শুধু তা-ই নয়, বাঙালির বিশ্বকর্মা স্বতন্ত্র পুজো এবং রীতিতেও। দক্ষিণ ভারতে দেবশিল্পীর পুজো হয় তিথি মেনে, মহানবমীর দিন। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে দিওয়ালির পরের দিন বিশ্বকর্মা পুজো হলেও বাংলায় এই পুজো সৌর ক্যালেন্ডার মেনে হয়। সূর্যের কন্যা রাশিতে প্রবেশ করার দিন (সাধারণত ১৭ সেপ্টেম্বর) বঙ্গে পূজিত হন বিশ্বকর্মা।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০১:১৬
উৎসব: রিকশা স্ট্যান্ডের পাশেই দেবশিল্পীর আরাধনার আয়োজন। শনিবার, সল্টলেকে। ছবি: শৌভিক দে

উৎসব: রিকশা স্ট্যান্ডের পাশেই দেবশিল্পীর আরাধনার আয়োজন। শনিবার, সল্টলেকে। ছবি: শৌভিক দে

তিনি বৃদ্ধ ছিলেন। বাংলায় এসে যুবক হয়েছেন!

এক সময়ে তিনি ছিলেন প্রথম সারির দেবতাদের এক জন। এখন হয়ে গিয়েছেন দেবশিল্পী! রাজহাঁসের বদলে বাহন হয়েছে হাতি।

তিনি বিশ্বকর্মা। বেদের চৌহদ্দি ছেড়ে আপাতত তাঁর ঠিকানা কারখানা, দোকান, মায় অটো স্ট্যান্ড, এমনকী সিন্ডিকেটের অফিসও।

শুধু তা-ই নয়, বাঙালির বিশ্বকর্মা স্বতন্ত্র পুজো এবং রীতিতেও। দক্ষিণ ভারতে দেবশিল্পীর পুজো হয় তিথি মেনে, মহানবমীর দিন। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে দিওয়ালির পরের দিন বিশ্বকর্মা পুজো হলেও বাংলায় এই পুজো সৌর ক্যালেন্ডার মেনে হয়। সূর্যের কন্যা রাশিতে প্রবেশ করার দিন (সাধারণত ১৭ সেপ্টেম্বর) বঙ্গে পূজিত হন বিশ্বকর্মা। বাকি ভারতের থেকে আলাদা হয়ে বাংলায় তাঁর পুজো মানে ঘুড়ির উৎসবও!

কোথায় ছিলেন বিশ্বকর্মা?

ইতিহাসবিদেরা বলছেন, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে বিশ্বকর্মার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে তিনি বিশ্বের স্রষ্টা। তাঁর যে রূপের কথা জানা যায়, তাতে বৃদ্ধ, এক মুখ সাদা গোঁফ-দাঁড়িতে ঢাকা। বাহন রাজহাঁস। অনেকটাই সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সমার্থক। অথর্ববেদেও তাঁর উল্লেখ রয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষিকা মধুপর্ণা রায়চৌধুরী বলছেন, বেদ-পরবর্তী যুগে কী ভাবে না জানি সেই পদ খোয়া গেল তাঁর! তিনি হয়ে উঠলেন দেবশিল্পী, কারিগরশ্রেষ্ঠ। দেবতাদের আয়ুধ নির্মাতা তিনি। সত্যযুগে তিনি স্বর্গ তৈরি করলেন। ত্রেতায় তৈরি করলেন রাবণের স্বর্ণলঙ্কা। দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা এবং পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থের রূপকারও তিনি। কিন্তু ওইটুকুই। তাঁর ধ্যানমন্ত্র থাকলেও মহিমা-কীর্তন কিন্তু সে ভাবে শোনা যায় না। কোনও মন্দিরের কথাও শোনা যায়নি।

দেবশিল্পী হিসেবেই তিনি ছড়িয়ে পড়েছেন পশ্চিম থেকে দক্ষিণ ভারতে। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক কীর্তি নারায়ণ তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, শুধু ভারত নয়, তাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশেও দেবশিল্পী হিসেবে বিশ্বকর্মার উল্লেখ মেলে। মধুপর্ণা জানান, দক্ষিণ ভারতে বিশ্বকর্মার সঙ্গে বাহন হিসেবে বাঘ ও গরুকে দেখা যায়। সেই রূপের সঙ্গে কোনও ভাবেই বাংলার হস্তীবাহন বিশ্বকর্মাকে মেলানো যায় না।

বাংলায় বিশ্বকর্মা এলেন কবে?

পূর্ব ভারতে সম্ভবত প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ওড়িশায়। জগন্নাথের মূর্তি তৈরির কারিগর ছিলেন বিশ্বকর্মা। পরবর্তী কালে মনসামঙ্গল কাব্যে লখিন্দরের লোহার বাসরঘরের কারিগরও এই দেবশিল্পীই। কিন্তু তাঁর রূপবর্ণনা কোথাও বলা হয়নি। বাংলার কারখানা আর দোকানে তিনি ঢুকলেন কবে? কী ভাবেই বা তিনি এমন সুপুরুষ হলেন?

সামাজিক ইতিহাসের গবেষক ও প্রবন্ধকার জহর সরকারের মতে, বাংলায় বিশ্বকর্মা পুজো উত্তর-ঔপনিবেশিক একটি ধারা। শিল্পভিত্তিক সমাজ কারিগরি উৎকর্ষের প্রতীক হিসেবে হিন্দুধর্ম থেকে বিশ্বকর্মাকেই বেছে নিয়েছিল। সেই কারণেই ইংরেজি ক্যালেন্ডার মেনে বিশ্বকর্মা পুজো হয়। এই সূত্র ধরেই সামাজিক ইতিহাসের এক গবেষক বলছেন, ‘‘নতুন দেবতারা সব সময়েই নিম্নবর্গের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পান। নিম্নবর্গীয় বাঙালি তাই নিজের কল্পনা মেনেই বিশ্বকর্মাকে যুবক হিসেবে বরণ করেছে।’’ জহরবাবুও বলছেন, তরুণ কারিগর, মিস্ত্রিদের জন্যই কার্তিকের মতো যুবক রূপ পেয়েছেন বিশ্বকর্মা।

তো এ হেন দেব-কারিগরের সঙ্গে ঘুড়ি কী ভাবে জুড়ল, তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, পশ্চিম ভারতে মকর সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ে। এ রাজ্যেও কোথাও কোথাও মকর সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে বাংলায় বর্ষা বিদায়ের অঙ্গ হিসেবে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব কোথাও যেন ভাদ্র শেষে শরতের আগমনের সূচনা হতে পারে। কাকতালীয় ভাবেই তা বিশ্বকর্মার সঙ্গে মিশে গিয়েছে।

ঔপনিবেশিক আমল থেকেই গঙ্গার দু’পারে চটকল এবং শিল্পতালুকগুলিতে বিশ্বকর্মা পুজোর রমরমা বেড়েছিল। সেই উৎসব কিন্তু ধর্মীয় আঙিনা ছেড়ে সামাজিক উৎসবে মিশে গিয়েছিল। ব্যারাকপুর, নৈহাটির বন্ধ হওয়া চটকলের বহু অহিন্দু শ্রমিক আজও মনে করতে পারেন, নববধূকে সাইকেলে চাপিয়ে কারখানায় ভোগ খেতে যাওয়ার কথা।

বাংলায় এসে আর রূপ বদলাননি বিশ্বকর্মা। তবে গত কয়েক দশকে ঠাঁই বদলে ফেলেছেন। চটকল, ভারী কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে ঠাঁই পাননি তিনি। তাই বিশ্বকর্মা এখন রিকশা
স্ট্যান্ড, অটো স্ট্যান্ড, প্রোমোটিং শিল্পেই থিতু হয়েছেন।

বিশ্বের স্রষ্টার সম্মান আপাতত এঁদেরই হাতে।

Vishwakarma Puja West Bengal বিশ্বকর্মা পূজা
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy