Advertisement
E-Paper

ইতিহাস আগলে এখনও দাঁড়িয়ে মেসবাড়িরা

শিবরাম কোন ঘরে থাকতেন? প্রশ্ন করায় সোৎসাহে দোতলার একটি ঘর দেখিয়ে দেন সেখানকার সবচেয়ে প্রবীণ বাসিন্দা উত্তমকুমার পাল।

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ২৩:০০
ঐতিহ্য: জীর্ণ প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস।  ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ঐতিহ্য: জীর্ণ প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

সরু, লম্বা, আধো-অন্ধকার একটা গলি। তার পরে ডান দিকে ঘুরলে ১৩৪, মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের ‘ক্ষেত্র কুঠি’। তিনতলা বাড়ির পলেস্তারা খসে পড়েছে। বারান্দা উধাও। বেরিয়ে রয়েছে লোহার কাঠামো। বাড়িতে ঢুকে সামনেই রান্নার ঘর। চলছে রাতের রান্নার আয়োজন। একে একে কাজ থেকে ফিরতে শুরু করেছেন মেসবাড়ির বাসিন্দারা। এখানেই থাকতেন সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী। যে মেসবাড়ি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, মুক্তারামে থেকে, তক্তারামে শুয়ে, শুক্তারাম খেয়েই তিনি শিবরাম হয়েছেন।

শিবরাম কোন ঘরে থাকতেন? প্রশ্ন করায় সোৎসাহে দোতলার একটি ঘর দেখিয়ে দেন সেখানকার সবচেয়ে প্রবীণ বাসিন্দা উত্তমকুমার পাল। আদতে বর্ধমানের বাসিন্দা, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চাকুরে উত্তমবাবু ক্ষেত্র কুঠিতে আছেন ৩৫ বছর ধরে। বলেন, ‘‘এখানে আসা ইস্তক ওঁর সর্ম্পকে অনেক গল্প শুনেছি। দোতলার এই ঘরে উনি একলাই থাকতেন। খুঁজলে দেওয়ালে ওঁর লেখাও পাবেন।’’ দেওয়ালের সাদা রং যেখানে উঠে গিয়েছে, সেখানে সত্যিই পেনসিলে লেখা ঠিকানা, ফোন নম্বর মিলল। শোনা যায়, শিবরাম দেওয়ালে রং করতে দিতেন না। সেখানে লেখা থাকত জরুরি বহু জিনিস। কারণ, খাতার মতো দেওয়ালের হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই!

৭২, বনমালী নস্কর লেন থেকে ব্যোমকেশের হ্যারিসন রোডের (এখন মহাত্মা গাঁধী রোড) আস্তানা হয়ে সাড়ে চুয়াত্তর— বাঙালির সমষ্টিগত স্মৃতিতে মেসবাড়ির জায়গা পাকা হয়ে গিয়েছে কবেই। শুধু তো ব্যোমকেশ নয়, ব্যোমকেশের স্রষ্টাও থাকতেন একটি মেসে। সেখানে থেকেছেন জীবনানন্দ দাশও। এ ছাড়াও শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মেসবাড়িতে থেকেছেন বহু স্বনামধন্য ব্যক্তি। কিন্তু দ্রুত পাল্টাতে থাকা শহরে আজ মেস অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক। পুরনো বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু মেস। আর এ ভাবেই একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে কলকাতার মেসবাড়ির ইতিহাস।

শিবরাম চক্রবর্তীর ঘরে আড্ডা আবাসিকদের। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

সেই ইতিহাস কিছুটা হলেও ধরে রাখার আবেদন নিয়ে বছর দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিল হেরিটেজ ওয়াক ক্যালকাটা নামে একটি সংস্থা। ওই সংস্থার কর্ণধার তথাগত নিয়োগী জানান, কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মেসবাড়ি নিয়ে সঠিক তথ্যের অভাব রয়েছে। তথ্য মিললে বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হবে। এর পরেই ওই সংস্থার ব্যবস্থাপনায় বর্ষণা বসু, আনমোল গ্রোভার এবং দীপান্বিতা পালের হাত ধরে শুরু হয় ‘মেসবাড়ি প্রজেক্ট’। বর্ষণা জানাচ্ছেন, গত শতকের গোড়ার দিকে কর্মসূত্রে শহরে আসা মানুষদের জন্যই গড়ে ওঠে মেসবাড়িগুলি। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট আর্কাইভ এবং ১৯১৫ ও ১৯৩৫ সালের স্ট্রিট ডিরেক্টরি ধরে খোঁজ চালিয়ে তাঁরা দেখেন, ১৯৭০ সালের আগে খোলা মেসের মধ্যে এখনও চালু আছে ২৬টি। তাঁদের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চালু থাকা মেসবাড়ির মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ১৯১১ সালে তৈরি হওয়া কলেজ স্কোয়ারের ব্যাপটিস্ট মিশন স্টুডেন্টস হল।

১৯২৯ সালে তৈরি হওয়া ক্ষেত্র কুঠির আবাসিকের সংখ্যা এখন ২১। প্রতি ঘরে তিন জ‌ন করে। সকলে ভাগ করে নেন বাজার করার দায়িত্ব। রান্নার জন্য রয়েছেন দুই কর্মচারী। খরচাপাতি চলে মেসের তহবিল থেকে। কেউ মেস ছেড়ে গেলে নতুন সদস্য আসেন চেনা কারও ‘রেফারেন্স’ নিয়ে। ফলে মেদিনীপুর ও বর্ধমানের বাসিন্দারাই মেস ভরিয়েছেন। সকালে খাওয়া সেরে সকলে বেরিয়ে গেলে খাঁ খাঁ করে মেস। সপ্তাহান্তে বা উৎসবেও ছবিটা একই। বাকি সময়ে সন্ধ্যার দিকে অবশ্য জমে আড্ডা বা তাসের আসর। বিভিন্ন পেশার, অসমবয়সী আবাসিকদের সেই আসরই মেসবাড়ির আসল মেজাজ। তবে বাড়ির জীর্ণ অবস্থার কথা উঠলে কিছুটা তাল কাটে সেই আসরের।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এককালের আস্তানা, ৬৬, মহাত্মা গাঁধী রোডের বাড়ির একতলায় রয়েছে একটি ভাতের হোটেল। বোর্ডে লেখা ‘প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস, স্থাপিত ১৯১৭’। জানা গেল, বোর্ডিং হাউস ঝাঁপ ফেলেছে বছর দুয়েক আগেই। শতাব্দীপ্রাচীন বাড়ির দোতলার কয়েকটি ঘরে জ্বলছে আলো। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কোন ঘরে থাকতেন প্রশ্ন করলে বাড়ি দেখভালের দায়িত্বে থাকা শেখ কাসেম আলি আঙুল দেখান তিনতলার দিকে— ভাঙাচোরা সিঁড়ি, ঘুটঘুটে অন্ধকার। যাওয়ার রাস্তা নেই।

বিশ্ব হেরিটেজ সপ্তাহ উপলক্ষে সম্প্রতি মেসবাড়ি প্রজেক্টের রিপোর্টটি জমা পড়েছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের কাছে। বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছে কমিশন? চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘একাধিক বিষয় খতিয়ে দেখে তবেই কোনও বাড়ি হেরিটেজ বলে ঘোষণা করা যায়। মালিকদের সম্মতির বিষয়টিও রয়েছে। লন্ডনের ধাঁচে কোনও বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে প্লাক লাগানো সম্ভব সহজেই। তবে কমিশন নিজে থেকে এটা করতে পারে না। এর জন্য কমিশনে চিঠি লিখতে হবে কোনও উৎসাহীকে।’’

History Presidency Boarding House Byomkesh Bakshi Shibram Chakraborty
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy