ফোন করলেই হাজির জার ভর্তি ‘মিনারেল জল’। ২০ লিটারের দাম ৩০ টাকা! দোকানে নামী ব্র্যান্ডের এক লিটারের জলের দাম ২০ টাকা। সেখানে এত কম দামে দিচ্ছে কী ভাবে?
সেটাই ‘ম্যাজিক’! বছর খানেক আগেই রাজ্য এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ (ইবি)-র হানায় ধরা প়ড়েছিল এই জল তৈরির কায়দা। ইবি সূত্রে বলা হচ্ছে, উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা কারখানার ভিতরে এমনি জলই পাইপ দিয়ে জারে ভরে দেওয়া হয়। তার পরে যন্ত্র দিয়ে জারের মুখ সিল করে দিলেই তৈরি ‘মিনারেল জল’।
সেই জলই গাঁ-গঞ্জ, মফস্সল, শহরতলি এমনকী খাস কলকাতার দোকানেও বিকোচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জল বিক্রয়কারী সংস্থার নাম অচেনা। কখনও কখনও চেনা ব্র্যান্ডও মেলে। নামী ব্র্যান্ডের ২০ লিটারের একটি জারের দাম ৮০-১১০ টাকা। তাই কম দামি জলের চাহিদাই বেশি।
আন্ত্রিকে নাজেহাল কলকাতার একাংশ। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, বোতল বন্দি, সিল করা পানীয় জলও নিরাপদ নয়। সেই জলেও মিলেছে কলিফর্ম ব্যাক্টিরিয়া। চিকিৎসক থেকে আমজনতার অনেকেই বলছেন, সস্তার জলের জারগুলিকেও পরিষ্কার করা হয় না। ফলে ভিতরে ছত্রাক, শ্যাওলা জন্মে যায়। সেই জল পেটে গেলে বিষক্রিয়া হতে পারে বলেই চিকিৎসকেরা মনে করছেন।
বোতলবন্দি জলে আলাদা করে পরিশোধক মেশাচ্ছেন আন্ত্রিক থেকে সদ্য সেরে ওঠা এক ব্যক্তি। কসবায়। শুক্রবার।
শুধু তাই নয়, নামী সংস্থার জলের গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। তার ছাড়পত্র রয়েছে। এই অচেনা সংস্থার সেগুলি থাকে কি? ইবি সূত্রে বলা হচ্ছে, গুণগত মান পরীক্ষা, ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস (বিআইএস) কিংবা ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (এফএসএসএআই) থেকে ছাড়পত্র তো দূর, অনেকের রেজিস্ট্রেশন নম্বরও জাল ছিল। গত বছর অভিযানের সময় প্রচুর ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন: দূষণ বেশি কীসে, চলছে জলঘোলা
পুলিশ জেনেছে, বিভিন্ন গ্রাম বা আধা শহরে পথেঘাটে কিংবা সংবাদপত্রে পরিস্রুত জলের প্ল্যান্ট তৈরির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সেই সব সংস্থাগুলিই এই সব কারখানা কী ভাবে চালাতে হবে, কী ভাবে জাল রেজিস্ট্রেশন নম্বর জোগা়ড় করতে হবে তার বুদ্ধি জোগায়। এরা সরাসরি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকে না। শুধু বুদ্ধি জোগানোর ‘ফি’ নেওয়া হয়।
তা হলে এদের উপরে নজর রাখবে কে? জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র বললেন, ‘‘কারখানাগুলি মাটি থেকে সাবমার্সিবল পাম্প দিয়ে যে জল তোলে, তার অনুমোদন আমরা দিই। কতটা জল তারা তুলবে, সেটা অবশ্য আমরা দেখি।’’ সরকারি হিসেব বলছে, সারা রাজ্যে এই ধরনের জল কারখানা রয়েছে ১২ হাজার।
খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলছেন, ‘‘নজরদারির কাজ আমাদের নয়। জেলায় আমাদের যে পরিকাঠামো রয়েছে, তাতে সেই কাজ সম্ভব নয়। জলের মান যাচাই করার জন্য পরীক্ষাগার কেবল কলকাতাতেই রয়েছে। তা দিয়ে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।’’
প্রশাসন সূত্রে বলা হচ্ছে, পানীয় জলের ক্ষেত্রে আইএসআই মার্ক পাওয়ার মুখ্য শর্ত হল কারখানায় মাইক্রোবায়োলজিক্যাল এবং কেমিক্যাল পরীক্ষাগার থাকতে
হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় বলেই দাবি সারা বাংলা নিরাপদ পানীয় জল উৎপাদক জনকল্যাণ সমিতির সম্পাদক নুরুল ইসলামের। তিনি বলছেন, ‘‘এই ধরনের পরীক্ষাগার তৈরি করতে ৪-৫ লক্ষ টাকা খরচ। সেই টাকা জোগাড় করতে গেলে প্রায় সব কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে।’’ কয়েকটি কারখানা মিলে পরীক্ষাগার তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল? কিন্তু অনুমোদন মেলেনি।
ছবি: রণজিৎ নন্দী