আগুন ছড়ায় ফুটপাত থেকে। —নিজস্ব চিত্র
চোখের সামনে আগুন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ল। তবু তা আটকানো গেল না কেন, এই প্রশ্নই রবিবার দিনভর শুনতে হল দমকলকে।
বাগড়ি বাজার থেকে ৫০০ মিটার দূরেই দমকলকেন্দ্র। শনিবার রাতে দমকলকর্মীরা আসতেই দেরি করেছেন এবং পর্যাপ্ত জল না নিয়েই এসেছিলেন বলে অভিযোগ উঠছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, এর ফলেই আগুন গ্রাস করেছে কার্যত গোটা বাড়িটিকে। বাগড়ি মার্কেটের এক ব্যবসায়ী রনিতা সাহা বলেন, ‘‘প্রথমে সি-ব্লকের সামনে মাত্র কয়েকটি দোকানে আগুন লেগেছিল। দমকলকর্মীদের চোখের সামনে সেই আগুন কী করে মার্কেটের ছ’টি ব্লকেই ছড়িয়ে পড়ল!’’ দমকলের ডিজি জগমোহন দাবি করেছেন, পৌঁছতে তাঁদের দেরি হয়নি। তা-ই যদি হয়, আগুন তবে বাগে আনা গেল না কেন, সেটাই প্রশ্ন ক্ষতিগ্রস্তদের।
রবিবার বেলা ১২টার সময়ে কলকাতা পুরসভার মেয়র তথা দমকলমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়কে ঘটনাস্থলে পেয়ে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। দমকল ব্যর্থ, তাই অবিলম্বে সেনা নামাতে হবে— এই দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন তাঁরা। উত্তেজিত ব্যবসায়ীরা বলতে থাকেন, ‘‘সেনা ডাকা হচ্ছে না কেন? কেন দমকল ফোম ব্যবহার করছে না!’’ শুধু মন্ত্রীর সামনেই নয়, ব্যবসায়ীদের কথায় সারাদিন ধরে উঠে এল দমকল বাহিনীর পরিকাঠামোর নানা ঘাটতির কথা।
কী সেই ঘাটতি? দমকলকর্তাদের একাংশ জানিয়েছেন, নন্দরাম মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের পরেই দমকল টের পেয়েছিল, সরু ঘিঞ্জি এলাকায় বহুতলের ভিতরে ঢুকে কাজ করার পরিকাঠামো নেই তাদের। এর জন্য দরকার ছোট হাইড্রলিক ল্যাডার বা যন্ত্রচালিত মই। এর পরে বিদেশ থেকে কেনাও হয় সেই মই। কিন্তু কাজের সময় দেখা গেল, ওই মই ঘিঞ্জি গলিতেও ঢোকানো যাচ্ছে না। কেন?
আগুনের নাগাল পেতেই হিমসিম দমকলের জল। ছবি: সুমন বল্লভ
দমকল সূত্রের খবর, রবিবার সকালেই ছোট হাইড্রলিক মই নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ক্যানিং স্ট্রিটের রাস্তার ওপরে মাকড়শার জালের মতো কেব্ল ও তার থাকায় তা উপরে তোলা যায়নি। দমকল বাহিনীর এক কর্তা জানান, তোলার সময়ে এই মই কোথাও বাধা পেলে নিজেই নেমে আসে। তাই মই তোলার চেষ্টাই করা হয়নি। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, শহরের রাস্তায় বড় শোভাযাত্রা হলেই অনেক সময়ে রাস্তার ওপরের তার কেটে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তা হল না কেন? দমকলকর্মীরা জানাচ্ছেন, রাস্তার উপরে বিদ্যুতের তারও রয়েছে। ওই তার কাটতে গেলে সমস্যা হতে পারে। আর এর ফলে, দমকলকর্মীদের সামনেই একে একে তিনতলা থেকে ছ’তলা পৌঁছেছে আগুন। আর সব হারিয়ে কপাল চাপড়েছেন ব্যবসায়ীরা। শুধু হাইড্রলিক মই-ই নয়, যেগুলো থাকলে মার্কেটের মধ্যে ঢুকে আগুনের সঙ্গে মুখোমুখি লড়তে পারতেন দমকলকর্মীরা, সেই ‘অগ্নিরোধক জ্যাকেট’ এবং ‘ব্রিদিং অ্যাপারেটাস সেট’-ও এ দিন দেখা যায়নি। কেন?
অগ্নি-পথ
• স্থানীয়দের দাবি, আগুন লাগে শনিবার রাত ২টোয়
• দমকলের দাবি, খবর আসে ২টো ৩৫ নাগাদ
• দমকল এল ২টো ৪৫
• সব থেকে কাছের দমকল কেন্দ্র লালবাজার, ৫০০ মিটার দূরত্বে
• রবিবার সকাল ১০টার মধ্যে তেতলায়, ১২টার মধ্যে ছ’তলায় আগুন
নিধিরাম সর্দার
• অভিযোগ, প্রায় ৪৫ মিনিট পরে এসেছে দমকল। পর্যাপ্ত জলও ছিল না দমকলের কাছে। তাই আগুন প্রথমেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। দমকল অভিযোগ অস্বীকার করেছে
• মার্কেটের ভিতরের লড়াইয়ে প্রয়োজন হাইড্রোলিক মই, অগ্নিরোধক জ্যাকেট এবং ব্রিদিং অ্যাপারেটাস সেট (বিটিএস)। হাইড্রোলিক মই ঢোকানো যায় রবিবার বিকেলে। টেন্ডার হলেও জ্যাকেট কেনা হয়নি। বিটিএস আসে দুপুরে।
প্রাক্তন এক দমকলকর্তা বলছেন, টেন্ডার ডাকা হয়েছিল, কিন্তু বিদেশ থেকে ‘অগ্নিরোধক জ্যাকেট’ এখনও হাতে আসেনি। বিষাক্ত ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করার ‘ব্রিদিং অ্যাপারেটাস সেট’ দমকলের সঙ্গে ছিল কিনা, সে-প্রশ্নের অবশ্য জবাব মেলেনি।
তবে এর মধ্যেই আবার সমন্বয়ের অভাবের অভিযোগও উঠেছে। দমকলকর্মীরা জানিয়েছেন, মার্কেটের ক্যানিং স্ট্রিটের দিকের গেট বন্ধ ছিল। প্রতিটি তলায় বাইরে থেকে কোনও ভাবেই জল দেওয়া যাচ্ছিল না। যে জায়গাতে আগুন লেগেছিল, সেখানে যাওয়ারও কোনও রাস্তাও জানা ছিল না। তাই দমকল আগুনের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি। পরে কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী জানলা বাইরে থেকে কেটে দেওয়ার ফলে দমকলকর্মীরা ভিতরে ঢুকতে পারেন। ওই সমন্বয় আগে হলে তাঁরা আরও দ্রুত আগুনের কাছে পৌঁছতে পারতেন বলে দাবি করেছেন দমকলকর্মীরা। পুলিশ অবশ্য এই সমন্বয়ের অভাবের অভিযোগ মানেনি। তবে ঘটনার দশ ঘণ্টা পরেও দেখা গিয়েছে, চারতলার এক দিকে থেকে বার হচ্ছে আগুনের শিখা। দমকলের কর্মীরা গাড়ির ওপর থেকে সেখানে জল দেওয়ার চেষ্টা করলে আগুনের জায়গাতে তা পৌঁছচ্ছে না।
আরও পড়ুন: পাম্প-বিভ্রাট, দেখভালে ফাঁকি আর মালিকানা-কাজিয়ার ফাঁকে আগুন?
একই সঙ্গে উঠেছে জলের অভাবের কথাও। ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, বারে বারে জলের অভাবে থমকে গিয়েছে আগুন নেভানোর কাজ। দমকলকর্মীরা ওই মার্কেটের তিনতলায় বেলা একটার দিকে পৌঁছে গেলেও জলের অভাবে প্রথমে কাজ করতে পারেননি। তাঁদের দিশাহীন অবস্থায় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। ওই মার্কেটে আগুন নেভানোর জন্য জলের রিজার্ভার-সহ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা কাজ করেনি বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy