Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কাজ হারানোর ভয়েই তারকারা মিছিলমুখো

গুঞ্জনটা ছিলই। শুক্রবার নন্দন থেকে অ্যাকাডেমি, সওয়া ঘণ্টার মিছিলে বিনোদন জগতের চেনা-আধা চেনা কয়েক জনকে এনে ‘গ্ল্যামার কোশেন্ট’ দেখিয়ে আস্ফালন করছিলেন সংস্কৃতি রক্ষার নতুন ঠিকাদারেরা। ঠিক পরের দিন রাজ্যের বিরোধী নেতারা সেই ‘অপ্রিয়’ গুঞ্জনটাকেই ফের উস্কে দিলেন। ওই মিছিলে (কেউ কেউ যাকে বলছেন ‘এপিসোড’) কিছু তারকা কেন হাজির হলেন, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রাখঢাক না করেই রাজ্যের শাসক দলকে বিঁধলেন তাঁরা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৫৯
Share: Save:

গুঞ্জনটা ছিলই। শুক্রবার নন্দন থেকে অ্যাকাডেমি, সওয়া ঘণ্টার মিছিলে বিনোদন জগতের চেনা-আধা চেনা কয়েক জনকে এনে ‘গ্ল্যামার কোশেন্ট’ দেখিয়ে আস্ফালন করছিলেন সংস্কৃতি রক্ষার নতুন ঠিকাদারেরা। ঠিক পরের দিন রাজ্যের বিরোধী নেতারা সেই ‘অপ্রিয়’ গুঞ্জনটাকেই ফের উস্কে দিলেন। ওই মিছিলে (কেউ কেউ যাকে বলছেন ‘এপিসোড’) কিছু তারকা কেন হাজির হলেন, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রাখঢাক না করেই রাজ্যের শাসক দলকে বিঁধলেন তাঁরা।

নেত্রীর আদেশে মিছিল বলে কথা! শুক্রবার নন্দন চত্বরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল, তৃণমূলের চাপে খানিকটা বাধ্য হয়েই শিল্পী-অভিনেতা-টেকনিশিয়ানেরা অনেকেই যোগ দিয়েছেন মিছিলে। তার প্রভাবও দেখা গিয়েছিল মিছিলে। অনেক শিল্পী-অভিনেতাই কার্যত মিছিলের মধ্যে সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে গিয়েছেন। যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁরাও ভাল করে বোঝাতে পারেননি, শুক্রবার ঠিক ‘কী হল, কেন হল’!

তারই রেশ ধরে শনিবার শিলিগুড়িতে প্রয়াত দলীয় নেতা আনন্দ পাঠকের অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দিতে এসে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেন, “তরুণ অভিনেতাদের নিয়ে কিছু বলতে চাই না। তাঁরা মিছিলে না হাঁটলে ভবিষ্যতে কাজ পেতে সমস্যা হবে। সেই কারণে উপরমহলের নির্দেশেই তাঁরা মিছিলে হেঁটেছেন।” রায়গঞ্জে দলের একটি কর্মিসভায় কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাশমুন্সি বলেন, “অনেকেই কিছু না জেনে রাজ্য সরকার ও তৃণমূলের চাপে পড়ে মিছিলে হেঁটেছেন।” স্বভাবতই বিমান-দীপাদের এই মন্তব্যে টলিউডের আনাচে-কানাচে ওঠা গুঞ্জন আচমকাই প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। এতে শাসক দল যত না বিব্রত, তার চেয়ে অনেক বেশি অস্বস্তিতে তাঁদের ঘনিষ্ঠ শিল্পী-অভিনেতারা।

শাসক দলের যে সব নেতা-মন্ত্রীরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে টলিউডের শিল্পীদের উৎসবে-অনুষ্ঠানে নিয়ে আসার কাজ দেখাশোনা করেন, তাঁদের কেউই অবশ্য এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

মিছিলের অন্যতম উদ্যোক্তা অরিন্দম শীলের বক্তব্য, “বিমানদাদের সময়েও যে সব মিছিলে যেতাম, সেগুলো কি চাপে পড়ে? ব্যক্তিগত একটা জায়গা থেকে অন্ধের মতো বামপন্থীদের সমর্থন করেছি। সে সময় এক পয়সার সুযোগ নিইনি। তাই এই সব অভিযোগ মানতে পারি না।” শাসক দল ঘনিষ্ঠ আর এক অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ আবার বলছেন, “বিমানবাবুর বয়স হয়েছে, পাগলামি বেড়েছে। যে ভুলটা বিমান বসুরা করেছেন, সেটা এখন তাঁরা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন।” মিছিলে যাওয়ার জন্য শাসক দলের তরফে কোনও হুমকি ছিল না দাবি করে রুদ্রনীলের সংযোজন, “ওঁদের সময়ে কিছু পক্ককেশ শিল্পী ছাড়া কাউকে সমাদর করা হয়নি। এখনকার সরকার সব শিল্পীকেই সমাদর করেছেন।”

তবে রুদ্রনীলের ভাষা ও মতের সঙ্গে তাল মেলাতে নারাজ বর্তমানে বাংলা সিনেমা ও টিভি সিরিয়ালের সঙ্গে যুক্ত অনেক কলাকুশলীই। তাঁদের অনেকেই (নাম না প্রকাশের শর্তে, অনেকে আবার পরেও ফোন করে মনে করিয়ে দিয়েছেন) জানাচ্ছেন, রাজ্যে পালাবদলের পরে রাজনীতির আবদার সামলানোর চাপ বেড়েছে। জনপ্রিয় টিভি সিরিয়ালের এক পরিচালকের বক্তব্য, “আগে কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে এমন রাজনৈতিক মেরুকরণ ছিল না। এমনকী, ঝেঁটিয়ে শিল্পীদের রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার চলও ছিল না। এখন তা শুরু হয়েছে। তাতে নতুন শিল্পীরা শাসক দলের অনুষ্ঠানে গা ভাসিয়ে দিয়ে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখার চেষ্টা করছেন।”

কলকাতার এক বিশিষ্ট প্রযোজকের দাবি, “আমার কাছে খবর আছে, একাধিক নায়ক শুক্রবারের মিছিলে যোগ দিতে রাজি ছিলেন না। এমনকী, তৃণমূল কংগ্রেসের এক সাংসদ নায়ককেও মিছিলে যোগ দেওয়াতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের।” ওই প্রযোজক জানাচ্ছেন, এক জন নায়িকাকে ভয় দেখানো হয়, মিছিলে না-হাঁটলে মহাকাব্য অবলম্বনে তৈরি হতে চলা ছবির অন্যতম কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র থেকে তাঁকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। রাজনৈতিক বর্তমান না মানলে ফিল্মি ভবিষ্যতে কী হবে, সে সম্পর্কে ‘ভাল করে বুঝিয়ে’ এক নব্য নায়ককে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য মিছিলে যোগ দেওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।

ওই প্রযোজকের ক্ষোভ, “শাসক দলের ঘনিষ্ঠ এক প্রযোজক এখন তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে সিনেমা-শিল্পে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। তিনি যে হেতু বাণিজ্যিক ছবির সঙ্গে সঙ্গে অন্য ধারার ছবিও করেন, তাই সেই সব ছবির সঙ্গে যুক্ত শিল্পীরাও ওই প্রযোজকের পছন্দের তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার ভয়ে মিছিলে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন।”

বাধ্য যে হতে হয়, তা মানছেন, নাট্যকার-অভিনেতা সুমন মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “একটা চাপ থাকে অস্বীকার করব না। টিকে থাকার চাপ। তবে যে হারে লোকে দল পাল্টাচ্ছে তাতে রাজনৈতিক সচেতনতার খামতিটাও এ যুগে প্রকট। শিল্পীরা বরাবরই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী। তারা এ ভাবে সরকারে কাছে আসার প্রতিযোগিতায় নামলে আশঙ্কা হয়।”

শিল্পী-অভিনেতাদের পেশায় নানা ধরনের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে সুমনের সঙ্গে এক মত আর এক নাট্যকার-অভিনেতা কৌশিক সেন। তবে তিনি বলেন, “বিমান বসুদের সমস্যা হল, ওঁরা এখনও ঠিকঠাক ভাষায় সমালোচনা করাটা শিখলেন না। কারণ, কাজ পাবেন না এই আশঙ্কায় সবাই মিছিলে গিয়েছেন, সেটা বলা ঠিক হবে না। আগেও বলেছি, মিছিল অত্যন্ত হাস্যকর ছিল। প্রতিবাদীদের অনেককে দেখেই তাঁদের হাবভাবে বিশ্বাসের কোনও ছাপ ছিল বলে মনে হয়নি। তা বলে, বিমানবাবুদের এই সমালোচনা ভাল লাগল না।”

শাসক দলের ঘনিষ্ঠ অনেক শিল্পীই আবার এই মিছিল এড়িয়ে গিয়েছেন বলে দাবি অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের। তাঁর কথায়, “তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ অনেক শিল্পীই কিন্তু মিছিলে যাননি। তাঁদের না-যাওয়াটাও বেশ প্রকট।” টালিগঞ্জ-ইন্ডাস্ট্রির যাঁদের হাঁটতে দেখা গিয়েছে, তাঁদেরও অনেকে ঠিকমতো মিছিলের কারণ ব্যাখ্যা করতে না পারায় বিস্মিত রূপা। তিনি বলেন, “যাঁরা গেলেন, তাঁদেরও অনেকে কেন গিয়েছেন, তা বলার চেষ্টা করলেন না। উল্টে সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ লুকিয়ে এক রকম পালিয়ে গেলেন। এটা অদ্ভুত লেগেছে।”

রূপার এই মন্তব্যের রেশ টেনে বিরোধী নেতাদের বক্তব্য, “কী করেই বা ওঁরা কিছু বলবেন! শাসক দলের নির্দেশে মিছিলে পা মিলিয়েছেন। কেন মেলাচ্ছেন, হয় তা বিচার করেননি। না হয় বিচার করেও মিছিলে যাওয়ার সাহস দেখাননি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE