E-Paper

‘মুক্তি’ দিতে সন্তানের জীবনকেও রেয়াত করছেন না ওঁরা

একের পর এক ঘটনা কি এ বার মা-বাবার সেই স্নেহবৎসল চরিত্রের দিকে অবিশ্বাসের প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে? একটি শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল তার বাবা-মা— এমন ধারণা কি বদলে ফেলার সময় এসেছে?

স্বাতী মল্লিক

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৫ ০৮:৪২
সন্তানের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু কেড়ে নিচ্ছেন মা-বাবারাই।

সন্তানের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু কেড়ে নিচ্ছেন মা-বাবারাই। —প্রতীকী চিত্র।

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’

ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের কবিতায় ঈশ্বরী পাটনির মতো যুগ যুগ ধরে সন্তানের জন্য এই বরই চেয়ে এসেছেন বাঙালি মা-বাবারা। সন্তানের সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘ জীবনই চরম কাঙ্ক্ষিত তাঁদের কাছে। তাই সন্তানের প্রতি স্নেহবৎসল, চিরচেনা পিতা-মাতার প্রতিভূ হয়েই রয়ে গিয়েছে খেয়াঘাটের মাঝি ঈশ্বরী।

কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে এই শহরের বুকে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা কি এ বার মা-বাবার সেই স্নেহবৎসল চরিত্রের দিকে অবিশ্বাসের প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে? একটি শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল তার বাবা-মা— এমন ধারণা কি বদলে ফেলার সময় এসেছে? অভিভাবকই যখন নিজের হাতে সন্তানকে খুন করে আত্মহননের পথে চলছেন— তখন প্রশ্ন উঠছে, এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা, যেখানে একটি শিশুর বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারটুকু কেড়ে নিচ্ছেন তার মা-বাবাই?

যুদ্ধের কারণে ব্যবসায় বিপুল ক্ষতির মুখে পড়ে সপরিবার আত্মহত্যা করতে চাওয়া ট্যাংরার দে পরিবারের ঘটনা গত মাস থেকেই খবরের শিরোনামে থেকেছে। তদন্তে উঠে এসেছে, ওই পরিবারের বছর চোদ্দোর কিশোরীটিকে নিজের হাতে খুন করেছেন তার মা-বাবা! জানা গিয়েছে, তার ঘরে, নিজের বিছানায় ঘুমের মধ্যে কিশোরীটির মুখে যখন বালিশ ঠেসে ধরেছিলেন বাবা, তখন তার পা দুটো শক্ত করে ধরে ছিলেন মা! যা শুনে শিউরে উঠেছেন অনেকে। এখানেই শেষ নয়। হালতুতে আড়াই বছরের দুধের শিশুকে শ্বাসরোধ করে মেরে আত্মঘাতী হয়েছেন দম্পতি। মধ্যমগ্রামে বছর পাঁচেকের মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যার পথে হেঁটেছেন মা। পর্ণশ্রীতে অটিস্টিক কন্যার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত পিতা সেই মেয়েকে নিয়েই গলায় দড়ি দিয়েছেন।

কেন সন্তানকেও রেয়াত করছেন না অভিভাবকেরা? মনোরোগ চিকিৎসক তথা এসএসকেএমের শিক্ষক-চিকিৎসক সুজিত সরখেল বলছেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে মা-বাবারা মনে করছেন, তাঁরা চলে গেলে তাঁদের উপরে নির্ভরশীল সন্তান আরও একা, অসহায় হয়ে পড়বে। বেঁচে থাকা আরও কঠিন হবে তার জন্য। তাই মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই সন্তানকে মুক্তি দিতে চাইছেন তাঁরা। এটা এক ধরনের অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থা, বিকৃত ভাবনার পরিচয়।’’

রাজ্য শিশু অধিকার ও সুরক্ষা কমিশনের উপদেষ্টা অনন্যা চক্রবর্তীর মতে, বর্তমান অর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার কারণে অনেকেই এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘দেশে এখন মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা, চাকরির বাজারের খারাপ অবস্থা। এর ফলে সমাজে বাড়ছে অপরাধ, হতাশা। সেই হতাশা থেকেই বাড়ছে আত্মহত্যা। আর তখন সন্তানের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু কেড়ে নিচ্ছেন মা-বাবারাই।’’

তবে, এই পরিস্থিতির জন্য অভিভাবকদেরই কাঠগড়ায় তুলছেন পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ। তাঁর মতে, তাৎক্ষণিক ভাবে সব কিছু পেয়ে যাওয়া প্রভাবিত করছে বড়দের মনকেও। তাঁরাও ভাবছেন, সমস্যার সমাধান এই মুহূর্তে চাই। আত্মকেন্দ্রিকতা এতটাই যে, পরবর্তী প্রজন্মকেও ঠিক ভাবে তৈরি করতে পারছেন না তাঁরা। ফলে কিশোর-কিশোরীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রভূত সম্ভাবনার দিকটিও তাঁদের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। পায়েলের কথায়, ‘‘পরিবারের ভাল-মন্দ আমিই ঠিক করব— এই ভাবনা প্রাধান্য পাচ্ছে। নিজেকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম দিচ্ছেন না তাঁরা। ছোটদেরও যে সমস্যার সঙ্গে যুঝতে পারার ক্ষমতা আছে, তা মনে করছেন না। তাই সন্তানকে আগলে রাখার মানসিকতা থেকেই এই ভাবনার জন্ম হচ্ছে যে, আমি ছাড়া ওকে কে দেখবে!’’ তা হলে উপায়? এ ক্ষেত্রে নতুন করে শুরু করার মানসিকতা, পরিবারের সদস্যদের এমনকি ছোটদের সঙ্গেও সমস্যা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে লড়াই করার মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া, প্রয়োজনে পরিবারের বাইরে অন্য কারও সঙ্গে সমস্যার কথা ভাগ করে নেওয়ার দিকে জোর দেওয়ার কথা বলছেন পায়েল।

শহরে একের পর এক সপরিবার আত্মহত্যার ঘটনা অনেকেরই মনে ফিরিয়ে আনছে দিল্লির বুরারি-কাণ্ডের স্মৃতি। ২০১৮ সালে বুরারি এলাকায় একই পরিবারের ১১ জনের একসঙ্গে আত্মহত্যা সে সময়ে নড়িয়ে দিয়েছিল জনসমাজকে। কোভিড-পর্বেও অভিনেতা সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর পরে একাধিক অভিনেতা-অভিনেত্রী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সুজিতের মতে, ‘‘এই ধরনের ঘটনা যত বেশি প্রচারের আলোয় আসবে, ততই ‘কপিক্যাট-আত্মহত্যা’র প্রবণতা বাড়বে। কারণ, একই রকম পরিস্থিতিতে থাকা পরিবারগুলিও ভাবতে শুরু করবে, আত্মহত্যাই একমাত্র পথ। তাই সংবাদমাধ্যমকে এমন খবর পরিবেশনের ক্ষেত্রে আরও সংযত, সচেতন ও সংবেদনশীল হতে হবে।’’

ট্যাংরা-কাণ্ডে কিশোরীর মৃত্যু হলেও বেঁচে গিয়েছে তার ভাই, বছর চোদ্দোর কিশোর। তবে তার বর্তমান মানসিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকেই। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সেই কিশোরকে সম্প্রতি দেখতে গিয়েছিলেন অনন্যা। বলছেন, ‘‘শিশুটির দীর্ঘ দিন ধরে কাউন্সেলিং করানো দরকার। ঘটনার অভিঘাতে ও যেন কাঁদতে ভুলে গিয়েছে। ওর কাঁদা দরকার।’’ আর হাল ছেড়ে দেওয়া অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে অনন্যা বলছেন, ‘‘সমস্যার কথা চেপে না রেখে কথা বলুন। দরকারে কমিশনের হেল্পলাইনে (৯৮৩৬৩০০৩০০) ফোন করুন। কিন্তু দয়া করে সন্তানের প্রাণ নেবেন না।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Children Psychology

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy