E-Paper

উপেক্ষিত অতীত বুকে নিয়েই উৎসবে খ্রিস্টানপাড়া

দু’হাজারেরও বেশি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের ঠিকানা, কেষ্টপুরের মিশনবাজার তথা খ্রিস্টানপাড়ার বড়দিন উদ্‌‌যাপন সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে মূলত স্থানীয় বাসিন্দাদের যোগদানের মধ্যেই।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:৫১
বড়দিন উপলক্ষে সাজানো হয়েছে জিশুর জন্মের কাহিনি। বুধবার, কেষ্টপুরের মিশনবাজারে।

বড়দিন উপলক্ষে সাজানো হয়েছে জিশুর জন্মের কাহিনি। বুধবার, কেষ্টপুরের মিশনবাজারে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।

পূতিগন্ধময় খাল দেখে কে বলবে, সেটির ধারেই লুকিয়ে রয়েছে উপনিবেশ তৈরির ইতিহাস? কেষ্টপুরের খ্রিস্টানপাড়া আর পাঁচটি শহরতলির মতোই একটি এলাকা। রাস্তার উপরে বসে মাছের বাজার। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাছের বাজারের দুর্গন্ধ ভেসে বেড়ায় বাতাসে। লোকজন আর যানবাহনে গিজগিজ করছে রাস্তা। তবু, মিশনবাজারের সামনে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো গির্জার ভিতরে ঢুকলে ঔপনিবেশিক ইতিহাস ভেসে উঠবে চোখের সামনে। বড়দিন না এলে বোঝারই উপায় থাকে না, এই সব চত্বরের গোড়াপত্তনের পিছনে রয়েছে ইউরোপীয় বণিক-নাবিকদের উদ্যোগ।

আজ, বৃহস্পতিবার বড়দিন উদ্‌যাপনে মেতে উঠবেন রাজ্যবাসী। কলকাতাবাসী তো বটেই, শহরতলি থেকেও অনেকে ছুটবেন পার্ক স্ট্রিট বা বো ব্যারাকে। কিন্তু দু’হাজারেরও বেশি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের ঠিকানা, কেষ্টপুরের মিশনবাজার তথা খ্রিস্টানপাড়ার বড়দিন উদ্‌‌যাপন সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে মূলত স্থানীয় বাসিন্দাদের যোগদানের মধ্যেই। আজও সে ভাবে পর্যটক বা অন্য এলাকার মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি এই চত্বর।

মিশনবাজারের কাছে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো গির্জার বর্তমান পুরোহিত, আচার্য শান্তনু গায়েন জানাচ্ছেন, প্রতি বছর ক্রিসমাস ইভের রাতে এবং বড়দিনের সকালেপ্রার্থনায় উপচে পড়ে স্থানীয় মানুষের ভিড়। তাঁদের গির্জার অধীনেএকাধিক স্কুল চলে। গির্জার ভিতরে বোর্ডে লেখা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলছে, এক সময়ে ওই এলাকা ছিল সুন্দরবনের ব-দ্বীপের মধ্যে। ১৮০৬ সালে এক প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে নেদারল্যান্ডস, পর্তুগাল এবং ব্রিটেনের বাণিজ্যতরী। ৪৭টি বাণিজ্যতরী তাতে আটকে পড়ে। পাঁচটি বাণিজ্যতরী রক্ষা পায় এবং এসে ধাক্কা খায় বিদ্যাধরী নদীর ধারে। কয়েক জন নাবিক কোনও ভাবে উদ্ধার পান। পরবর্তী কালে তাঁদের উদ্যোগে ইউরোপীয় সভ্যতার ছোঁয়া লেগে ওই মিশনবাজার তৈরি হয়। সেই বাজার আজও মিশনারিদের মালিকানাধীন জমিতেই বসে বলে জানালেন এলাকার বাসিন্দারা।

এলাকার পুরনো বাসিন্দা তথা বিধাননগর পুরসভার স্থানীয় পুরপ্রতিনিধি সুশোভন (মাইকেল) মণ্ডল জানান, দু’টি বুথ মিলিয়ে দু’হাজারেরও বেশি খ্রিস্টান মানুষের বসবাস ওই এলাকায়। বর্তমানে এলাকার গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া কেষ্টপুর খাল সেই সময়ে ছিল ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যপথ। মাইকেলের কথায়, ‘‘এখানে তিনটি বড় গির্জা রয়েছে। এ ছাড়া, অনেকের বাড়িতেও ছোট ছোট গির্জা রয়েছে। আমরা তখন অনেক ছোট। ২৫-৩০ বছর আগে ড্রেজিংয়ের সময়ে কেষ্টপুর খাল থেকে ছোট জাহাজের কাঠামো উদ্ধার হয়েছিল। কেষ্টপুর খাল এখনও গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত। অন্য দিকে, এ দিকের খালগুলি বিভিন্ন পথ ধরে বিদ্যাধরী নদীতে গিয়েই মিশছে।’’ যদিও বর্তমানে সেই কেষ্টপুর খাল পূতিগন্ধময় অবস্থায় রয়েছে।

কেষ্টপুর খালের ধার বরাবর খ্রিস্টানপাড়ার একটি বড় অংশ। মূলত নিম্নবিত্ত মানুষের বসবাস। বড়দিনের আগের দুপুরে ওই জায়গায় গিয়ে দেখা গেল, উৎসব শুরুর প্রস্তুতি-পর্বে রং করা হচ্ছে জিশু খ্রিস্টের মূর্তিতে। খালপাড়ের বিভিন্ন বাড়ির সামনে যিশুর জন্মের ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলতে তৈরি হয়েছে গোয়ালঘর। টিন-টালির তৈরি ঘর থেকে পাকা বাড়ি— প্রায় প্রতিটি খ্রিস্টান পরিবারই উৎসবের তোড়জোড়ে ব্যস্ত। বাড়িতে তৈরি কেক বিলি করা হচ্ছে প্রতিবেশীদের বাড়িতে। সান্তা ক্লজ় আর ঝলমলে ক্রিসমাস ট্রি রাখা বিভিন্ন বাড়ির বাইরে। এলাকায় মেলা বসেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা সিমন সরকার, খোকন সর্দার কিংবা বৃদ্ধা সুন্দরী মণ্ডলেরা জানালেন, দুর্গাপুজোকিংবা কালীপুজোর মতোই বড়দিনে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশীর সঙ্গেআনন্দ ভাগ করে নেন তাঁরা। সুন্দরীর কথায়, ‘‘নাতি-নাতনিরা মিলে ঘর সাজিয়েছে। বড়দিনে বাড়িতে বিরিয়ানি, কাটলেট তৈরি হবে। অনেকেই নিমন্ত্রিত।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

christmas Keshtopur

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy