আলো ঝলমলে পরিবেশ। বাগান হয়েছে, ছবি বসেছে, মৃদু সঙ্গীত চলছে, পরিচ্ছন্নতাও বেড়েছে অনেকটাই। সব মিলিয়ে সাজানো-গোছানো। তবু কেওড়াতলা শ্মশানকে কেন্দ্র করেই ইদানীং ফের শুরু হয়েছে সমাজবিরোধী কার্যকলাপ। বসছে মদ-জুয়া-গাঁজার ঠেক। সেই সঙ্গে চলছে মৃতের বাড়ির লোকজনকে হেনস্থা করা। পরিস্থিতি এমনই যে, এলাকার প্রায় দেড়শো জন বাসিন্দা সম্প্রতি পুলিশের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে এই সমস্যার সুরাহা চেয়েছেন।
পুলিশের একটি সূত্রের বক্তব্য, মাত্র চার জন পুলিশ শ্মশানের জন্য মোতায়েন থাকেন। পরিস্থিতি সামলাতে অন্তত ১০ জনের দরকার। কলকাতা পুরসভার হিসেবে, রোজ কেওড়াতলা শ্মশানে গড়ে ৭০-৮০টি দেহ দাহ করা হয়। শীতে এই সংখ্যাটাই বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ থেকে ১২০-তে।
কেওড়াতলা শ্মশানে সত্যজিৎ রায়ের অন্ত্যেষ্টির দিন কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে ‘সাহাদা’ বলে সম্বোধন করে এক সমাজবিরোধী। যে তখন পরিচিত ছিল ‘শ্মশান স্বপন’ নামে। ২৫ বছর আগের ওই ঘটনায় বেআব্রু হয়ে গিয়েছিল কেওড়াতলা শ্মশানের সিন্ডিকেট-রাজ (তখন অবশ্য এই শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হতো না) এবং পুলিশ-প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে তাদের দহরম-মহরম।
এখন বিষয়টি সেই পর্যায়ে না পৌঁছলেও যা শুরু হয়েছে, তাতে অশনি সঙ্কেত দেখছেন এলাকাবাসীরা। পুলিশই জানাচ্ছে, সম্প্রতি বজবজ থেকে এক ব্যক্তির মৃতদেহ দাহ করতে কেওড়াতলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মৃতের সঙ্গে আসা লোকজনের কেউ কেউ মত্ত অবস্থায় ছিল। তারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে শ্মশান চত্বরেই হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে।
শ্মশান লাগোয়া সাহানগর রোড ও টালিগঞ্জ রোডে রয়েছে প্রচুর বসতবাড়ি। ওই তল্লাটের লোকজনই ১৭ নভেম্বর টালিগঞ্জ থানায় গণ-স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, গত কয়েক বছরে
শ্মশানের উত্তরোত্তর উন্নতি হয়েছে। পরিষেবাও ভাল হয়েছে, কিন্তু শ্মশান ঘিরে চলা অসামাজিক কার্যকলাপ লাগোয়া এলাকার মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপদ্রবও বাড়ে। এমনকী, কিছুকাল যাবৎ সাহানগর রোড ও টালিগঞ্জ রোডে চালু হওয়া গাড়ির বেআইনি পার্কিং আরও সমস্যা তৈরি করছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ।
কখনও এক বা একাধিক ছাত্রী শ্মশান লাগোয়া রাস্তা দিয়ে টিউশন শেষে বাড়ি ফেরার সময়ে মৃতদেহের সঙ্গে আসা মত্ত যুবকদের কটূক্তির শিকার হচ্ছে। কখনও বা কোনও স্থানীয় বাসিন্দা টালিগঞ্জ রোডে বসা মদ-জুয়ার ঠেক থেকে ভেসে
আসা অশ্লীল, অশ্রাব্য কথাবার্তার প্রতিবাদ করলে তা নিয়ে বাঁধছে গণ্ডগোল। কখনও কখনও তা ছড়িয়ে পড়ছে শ্মশান চত্বরেও। এক পুলিশকর্তা স্বীকার করে নেন, ‘‘কেও়ড়াতলা শ্মশান ঘেঁষা আদিগঙ্গার পাড়ে প্রায়ই অসামাজিক কার্যকলাপ চলে। মাঝেমধ্যে টালিগঞ্জ থানার পুলিশ অভিযান চালায়, ধরপাকড় করে। তবে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি সম্ভব হচ্ছে না।’’
শহরের উত্তরে নিমতলা শ্মশানকে ঘিরে অবৈধ ও অসামাজিক কাজকর্ম যে একেবারেই নেই, তা নয়। তবে এলাকার মানুষ সেখানে ততটা সমস্যায় পড়ছেন না। কলকাতা পুরসভা ও পুলিশ দু’পক্ষই বলছে, নিমতলা শ্মশান লোকালয় থেকে কিছুটা তফাতে, গঙ্গার পাড়ে। কেওড়াতলার সীমানা পাঁচিলের গায়েই যেমন বসতবাড়ি রয়েছে, নিমতলায় অবস্থা সে রকম নয়। যে কারণে নিমতলার বাসিন্দারা তুলনামূলক ভাবে স্বস্তিতে।
কেওড়াতলা শ্মশান কলকাতা পুরসভার ৮৮ নম্বর ওয়ার্ডে। পুরসভার চেয়ারপার্সন মালা রায়ই স্থানীয় কাউন্সিলর। মালাদেবীর কথায়, ‘‘শ্মশানের পরিষেবার উন্নতি হলে কী হবে, শ্মশানকে ঘিরে কিছু সমাজবিরোধীর ঠেক তৈরি হওয়ার ফলে সামাজিক পরিবেশ দূষিত
হচ্ছে। পুলিশকে বার বার জানালেও কোনও কাজ হচ্ছে না।’’ মালাদেবী বলেন, ‘‘শ্মশানে পুলিশ ফাঁড়ি হয়েছে বহু বছর যাবৎ। এখন সেখানে
থাকেন হাতে গোনা কয়েক জন পুলিশ। পুরসভা থেকে পুলিশকে নতুন বাড়িতে জায়গাও দেওয়া হয়েছে। তবু পুলিশ সমস্যার সুরাহা করতে
পারছে না।’’
এক পুলিশ আধিকারিক অবশ্য জানাচ্ছেন, ফাঁড়ি বা আউটপোস্ট বলতে যা বোঝায়, কেওড়াতলায় সে রকম কিছু কোনও দিনই ছিল না। সেখানে ২৪ ঘণ্টা এক জন এএসআই ও তিন জন কনস্টেবল মোতায়েন রাখা হয়। তাঁদের মূল কাজ, মৃতদেহগুলি যাতে ক্রম অনুসারে দাহ করা হয় এবং তা নিয়ে কোনও গণ্ডগোল যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করা। ওই অফিসারের কথায়, ‘‘শ্মশানকে ঘিরে থাকা পাড়ার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা ওই চার জন পুলিশের পক্ষে সম্ভব না। তার জন্য পুরোদস্তুর ফাঁড়ি দরকার।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy